পণপ্রথা : অশিক্ষা, সংস্কার ও ইসলামের সত্য বার্তা

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 4 h ago
পণপ্রথা ও ইসলামের অবস্থান , নারীর মর্যাদার সংগ্রাম
পণপ্রথা ও ইসলামের অবস্থান , নারীর মর্যাদার সংগ্রাম
 
ড. উজমা খাতুন
 
ভারতের সমাজে পণ আজ এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ। প্রতিদিন সংবাদপত্রে ভেসে আসে নারীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ দেহ কিংবা আত্মহত্যার খবর। নিক্কি নামের এক নববধূকে পণ না মেলার অজুহাতে তার স্বামীর পরিবার জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল, এ দৃশ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, পণ কেবল অর্থের লেনদেন নয়, বরং নারীর জীবন-মরণের প্রশ্ন।
 
জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর হিসাব বলছে, প্রতি বছর হাজারো নারী এই নৃশংসতার শিকার হন।
 
পণ আসলে কী?
 
পণ বলতে বোঝায়, কন্যার পরিবার থেকে বিয়েতে প্রদত্ত অর্থ, সম্পদ বা উপহার। একসময় এটি ছিল কন্যাকে নতুন সংসার শুরু করতে সহায়তা করার একধরনের স্বেচ্ছা উপহার। আইন অনুযায়ী, বিয়ের সময় দাবি বা বিনিময়ের মাধ্যমে দেওয়া কোনো কিছুই পণের অন্তর্ভুক্ত, তবে স্বেচ্ছাপ্রদত্ত উপহার আলাদা। আধুনিক সমাজে পণ সাধারণত নগদ অর্থ, অলঙ্কার কিংবা গৃহস্থালি সামগ্রীর আকারে দেওয়া হয়। অনেক সময় কন্যারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বঞ্চনা ভোগ করে; সেক্ষেত্রে পণকে তাদের প্রাপ্য সম্পত্তির অংশ হিসেবে যুক্তি দেওয়া হয়।
 
প্রতিনিধিত্বমুলক ছবি
 
আসল উদ্দেশ্য বনাম বর্তমান রূপ
 
প্রথমে পণকে দেখা হতো কন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা রূপ নিয়েছে এক ভয়ঙ্কর অস্ত্রে, যেখানে কনের পরিবারকে বাধ্য করা হয় বাড়তি চাহিদা মেটাতে। দরিদ্র পরিবার ঋণে জর্জরিত হয়, আর কন্যারা হয়ে পড়ে একপ্রকার দরকষাকষির বস্তু। যে ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল নারীর সুরক্ষা, তা-ই আজ তাদের সর্বাধিক নিপীড়নের কারণ।
 
পক্ষসমর্থনের ভ্রান্তি
 
অনেকে পণের পক্ষে যুক্তি দেন, এটি নাকি নারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে, পরিবারের সামাজিক মর্যাদা উঁচু করে কিংবা ভালো বিবাহের সুযোগ নিশ্চিত করে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, নগদ অর্থ, গহনা বা কাপড়, এসবের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ সচরাচর নারীর হাতে থাকে না। সবই চলে যায় স্বামীর পরিবারের দখলে। ফলত, নারী স্বাধীনতা বা নিরাপত্তা কিছুই পায় না। বরং পণ তাকে আরও নির্ভরশীল করে তোলে।
 
পণ : এক অদৃশ্য ফাঁস
 
কন্যাসন্তান মানেই বোঝা, আর পুত্রসন্তান মানেই বিনিয়োগ। পণপ্রথা সমাজে এই ভয়ঙ্কর ধারণাই রোপণ করেছে। বাবা-মা বাধ্য হন ঋণ নিয়ে অযথা ব্যয় করতে, আর দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয় পুলিশ-আদালতের অবহেলায়। যে বিবাহ হওয়ার কথা ছিল ভালোবাসা ও পবিত্র বন্ধনের, তা আজ পরিণত হয়েছে নগদ লেনদেনের এক বাজারে।
 
নারী, শোষণের চক্রে বন্দি
 
পণের চাহিদা পূরণ না করতে পারলেই নববধূকে গঞ্জনা, নির্যাতন, এমনকি হত্যার শিকার হতে হয়। সরকারি নথিতে প্রতিবছর প্রায় ৬,০০০ নারী মৃত্যুর শিকার হন, অথচ প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়েও ভয়াবহ। প্রতিটি মৃত্যু মানে একেকটি কন্যা, একেকটি মা, একেকটি স্ত্রীর জীবন অকালে নিভে যাওয়া।
 
এই ব্যবস্থায় কনে কোনো পক্ষই নয়, সে কেবল এক বিনিময়ের বস্তু। কখনো স্বামী, কখনো শাশুড়ি, কখনো ননদের হাতে তার ওপর ঝরে পড়ে নিষ্ঠুরতা। নারীরাই নারীর ওপর শোষণের শৃঙ্খল বেঁধে দেয়।
 
সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের অজুহাত
 
কিছু ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস নারীর পরাধীনতাকে স্বাভাবিক করেছে। আদর্শ স্ত্রী মানে যে স্বামীর জন্য সব ত্যাগ করবে, এমনকি প্রাণও। এভাবেই যুগের পর যুগ নারীদের শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের মূল্য নির্ভর করে অন্যের ওপর, নিজের নয়।
 
পণ ও হত্যার শিকার দুটি পরিবারের ছবি (ফাইল)
 
শোষণের অন্তহীন দাসত্ব
 
যা ছিল একসময় স্বেচ্ছার উপহার, তা আজ পরিণত হয়েছে নিরবচ্ছিন্ন দাসত্বে। বিয়ের পরও দাবি থামে না। পূরণ করতে না পারলে মৃত্যুই শেষ গন্তব্য। আশির দশকে পণ-জনিত মৃত্যু দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজও সেই একই সংবাদ শিরোনামে জায়গা করে নেয়।
 
আইন আছে, কার্যকারিতা নেই
 
১৯৬১ সালে পণনিষিদ্ধ আইন প্রণীত হলেও এর বাস্তব রূপ প্রায় অকার্যকর। পরিবারগুলো ভয় পায়, সমাজ কি বলবে! পুলিশ আর আদালত প্রায়শই নির্যাতিতাদের অভিযোগকে অগ্রাহ্য করে, দুর্নীতি বিচারপ্রক্রিয়াকে পঙ্গু করে। এমনকি মৃত্যুপূর্ব স্বীকারোক্তিও অনেক সময় আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয় না। ফলে অপরাধীরা থেকে যায় অদণ্ডিত, আর বিচার হয় অধরাই।
 
কেন পণ এখনো টিকে আছে?
 
কারণ, এটি সমাজের গভীরে গেড়ে বসেছে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, জাতপাতের গর্ব, কন্যাদের অবমূল্যায়ন, সব মিলিয়েই পণপ্রথাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যেমন সতী একসময় নারীদের প্রাণ কেড়ে নিত, তেমনি পণও আজ নারীহত্যার আধুনিক রূপ।
 
সমাধানের পথ
 
শিক্ষাকে অনেক সময় সমাধান হিসেবে দেখা হয়। সত্যিই এটি সচেতনতা তৈরি করে, লিঙ্গসমতা প্রচার করে এবং নারীর আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে। কর্মীরা পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক প্রচারণায় কাজ করেছেন। কিন্তু শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। সামাজিক চাপ, পারিবারিক সম্মান আর সম্প্রদায়ের প্রথা প্রায়শই বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে ছাপিয়ে যায়।
 
বিস্ময়ের বিষয়, কখনো কখনো শিক্ষাই পণ-প্রথাকে উল্টো বাড়িয়ে তোলে। শিক্ষিতা কন্যার জন্য বরপক্ষ বেশি পণ দাবি করে, কারণ মনে করা হয়, বর যত শিক্ষিত, তত বেশি অর্থ বা সম্পদ পাওয়া উচিত। ফলত, অনেক পরিবার কন্যার পড়াশোনার পেছনে নয়, বরং পণ জোগাড় করতেই বেশি ব্যয় করে। কন্যাদের শিক্ষা বিনিয়োগ নয়, ব্যয় হিসেবেই দেখা হয়। এমনকি অনেক সময় দেখা যায়, মেয়েরা বেশি পড়াশোনা করলে তাদের বিবাহের সম্ভাবনা কমে যায়, কারণ অনেকে "অতিরিক্ত শিক্ষিত" কনে গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে। এর ফলে কন্যাদের বিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ার হার বেড়ে যায়।
 
সমাজ ও সংস্কৃতির শিকড়ে পণ
 
পণ শুধু ভারতের সমস্যা নয়, বরং যেখানে নারীদের সম্পত্তি মনে করা হয়—সেই সমাজেই এটি ভিন্ন রূপে দেখা দেয়। সংস্কৃতি, জাতপাত, ধর্মীয় প্রথা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে পণের সম্পর্ক অটুট। আন্তর্জাতিক মহল, নারী আন্দোলন ও বিভিন্ন প্রচারণা পণের নিষ্ঠুরতা তুলে ধরেছে। কিন্তু কার্যকর পরিবর্তন আসতে হলে তা সমাজের ভেতর থেকেই ঘটতে হবে।
 
ইসলামিক বিবাহের একটি ছবি ( ফাইল)
 
ইসলামের অবস্থান
 
আজকের প্রচলিত পণ সম্পূর্ণ অনইসলামিক। ইসলাম বিবাহকে সম্মান ও পারস্পরিক সম্মতির ওপর দাঁড়ানো এক পবিত্র চুক্তি বলে বিবেচনা করে। ইসলাম নারীদের বোঝা মনে করে না, বরং কন্যাকে ভালোবাসায় লালন করা সওয়াবের কাজ। ইসলামে বিবাহ শুরু হয় নিকাহ দ্বারা, যা উভয় পক্ষের স্বাধীন সম্মতিতে সম্পাদিত হয়। নারীকে জোর করে বিবাহ দিলে তা প্রত্যাখ্যানের অধিকার তার রয়েছে। বিবাহ মূলত সহচরিতা, সহায়তা ও পরিবার গড়ার উদ্দেশ্যে, অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য নয়।
 
মহরের মর্যাদা
 
ইসলামী বিবাহের কেন্দ্রে রয়েছে মহর, যা কনের একান্ত অধিকার। বর এটি প্রদান করবে, কিন্তু তা কখনো ফেরত নেওয়া যাবে না। মহর নারীর নিরাপত্তা ও সম্মানের প্রতীক। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর স্ত্রীদের মহর প্রদান করেছেন এবং সরল ও সহজ বিবাহের ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর কন্যা ফাতিমার বিবাহেও উপহার ছিল অতি সাধারণ ও প্রতীকী—যা স্পষ্ট করে দেয় যে বিবাহ হওয়া উচিত সরল, নয় বোঝাস্বরূপ।
 
মুসলিম সমাজে পণপ্রথা
 
দুঃখজনকভাবে, ভারতের মুসলিম সমাজেও পণ প্রবেশ করেছে। স্বেচ্ছা উপহার আজ চাহিদায় পরিণত হয়েছে, যা নির্ধারিত হয় বরপক্ষের শিক্ষা বা সামাজিক মর্যাদা দিয়ে। দরিদ্র মুসলিম পরিবারও এতে পিষ্ট হচ্ছে, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে পণ-হেনস্তা ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে। স্পষ্ট বোঝা যায়, সংস্কৃতির চাপ অনেক সময় ধর্মীয় শিক্ষাকেও ছাপিয়ে যায়।
 
পরিবর্তনের পথ
 
সমাজ পরিবর্তনের শুরু হতে হবে ভেতর থেকে। মুসলিম সমাজকে ইসলামের মূলনীতিতে ফিরতে হবে, যেখানে পণের কোনো স্থান নেই, বরং মহরই নারীর অধিকার। নারীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে, পুরুষদের মহর ও দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে হবে। উত্তরাধিকার ও সম্পত্তির বণ্টন ইসলামী বিধান অনুসারে নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে নারীর শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে শোষণ প্রতিহত করা সম্ভব হবে। রাসূলুল্লাহর (সা.) সরলতা ও ন্যায়পরায়ণতার আদর্শ অনুসরণ করেই মুসলিমরা সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
 
ইতিহাসের শিক্ষা
 
পণ শুধু ভারতে নয়, প্রাচীন ইউরোপ ও এশিয়ার সমাজেও ছিল। একে কন্যার সম্পত্তির অংশ হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা সমাজে পণ বিলুপ্ত হয়েছে। গ্রিসসহ অনেক দেশে নগরায়ণ ও লিঙ্গ-ভূমিকায় পরিবর্তনের ফলে পণ-প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে।
 
ভারত ব্যতিক্রম, এখানে বরং পণ সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বড় কারণ দুটি:
 
১. জনসংখ্যার চাপ, ফলে বিবাহের সুযোগ কমে গেছে।
 
২. উচ্চ মর্যাদার প্রতি আকাঙ্ক্ষা (হাইপারগ্যামি), যেখানে পরিবারগুলো উচ্চশিক্ষিত, শহুরে ও কর্মরত পুরুষকে বর হিসেবে চাইছে এবং এজন্য বড় অঙ্কের পণ দিচ্ছে। এর ফলেই শহরেও পণের মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
 
পণ বিরোধী কণ্ঠ
আশার আলো
 
কিছু গবেষকের মতে, নগরায়ণ, নারীর শিক্ষা বৃদ্ধি এবং গ্রাম-শহর বিভাজন কমে গেলে ভারতে একদিন পণ হ্রাস পেতে পারে। তবে এটি সময়সাপেক্ষ। যতদিন না সমাজে কন্যারা স্বামীর ঘরে গিয়ে বসবাস করবে আর পুত্ররা বাবা-মায়ের সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে, ততদিন পণ-প্রথা টিকে থাকবে।
 
পণমুক্ত সমাজের জন্য করণীয়
 
শুধু আইন নয়, প্রয়োজন সামাজিক সংস্কার।
 
নারীর উত্তরাধিকার ও সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
 
আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ে ও উপহার বর্জন করে সরলতা গ্রহণ করতে হবে।
 
ধর্মীয় ও সামাজিক নেতা স্পষ্টভাবে পণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন।
 
বিদ্যালয়ে ছোটবেলা থেকে লিঙ্গসমতার শিক্ষা দিতে হবে।
 
নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
 
পণ কেবল এক বিবাহ-প্রথা নয়; এটি বৈষম্য, লোভ ও শোষণের প্রতীক। এটি জীবন নষ্ট করে, পরিবার ধ্বংস করে এবং বিবাহের পবিত্রতাকে কলুষিত করে। আইন আছে, কিন্তু কার্যকর হবে না যদি না সমাজ বদলায়। শিক্ষা, সংস্কার, সমঅধিকার ও নারীর ক্ষমতায়ন, এই চার হাতিয়ারেই পণমুক্ত ভারত গড়া সম্ভব। মুসলিম সমাজ যদি প্রকৃত ইসলামী নীতির ওপর ফিরে আসে, মহর ও সরলতাকে মেনে চলে, তবে তারা পথপ্রদর্শক হতে পারে।
 
শুধুমাত্র তখনই পণ সত্যিকার অর্থে বিলুপ্ত হবে, আর নারীরা পাবে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সমঅধিকার।
 
( ড. উজমা খাতুন, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়)