বিস্ময়ের বিষয়, কখনো কখনো শিক্ষাই পণ-প্রথাকে উল্টো বাড়িয়ে তোলে। শিক্ষিতা কন্যার জন্য বরপক্ষ বেশি পণ দাবি করে, কারণ মনে করা হয়, বর যত শিক্ষিত, তত বেশি অর্থ বা সম্পদ পাওয়া উচিত। ফলত, অনেক পরিবার কন্যার পড়াশোনার পেছনে নয়, বরং পণ জোগাড় করতেই বেশি ব্যয় করে। কন্যাদের শিক্ষা বিনিয়োগ নয়, ব্যয় হিসেবেই দেখা হয়। এমনকি অনেক সময় দেখা যায়, মেয়েরা বেশি পড়াশোনা করলে তাদের বিবাহের সম্ভাবনা কমে যায়, কারণ অনেকে "অতিরিক্ত শিক্ষিত" কনে গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে। এর ফলে কন্যাদের বিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ার হার বেড়ে যায়।
সমাজ ও সংস্কৃতির শিকড়ে পণ
পণ শুধু ভারতের সমস্যা নয়, বরং যেখানে নারীদের সম্পত্তি মনে করা হয়—সেই সমাজেই এটি ভিন্ন রূপে দেখা দেয়। সংস্কৃতি, জাতপাত, ধর্মীয় প্রথা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে পণের সম্পর্ক অটুট। আন্তর্জাতিক মহল, নারী আন্দোলন ও বিভিন্ন প্রচারণা পণের নিষ্ঠুরতা তুলে ধরেছে। কিন্তু কার্যকর পরিবর্তন আসতে হলে তা সমাজের ভেতর থেকেই ঘটতে হবে।
ইসলামিক বিবাহের একটি ছবি ( ফাইল)
ইসলামের অবস্থান
আজকের প্রচলিত পণ সম্পূর্ণ অনইসলামিক। ইসলাম বিবাহকে সম্মান ও পারস্পরিক সম্মতির ওপর দাঁড়ানো এক পবিত্র চুক্তি বলে বিবেচনা করে। ইসলাম নারীদের বোঝা মনে করে না, বরং কন্যাকে ভালোবাসায় লালন করা সওয়াবের কাজ। ইসলামে বিবাহ শুরু হয় নিকাহ দ্বারা, যা উভয় পক্ষের স্বাধীন সম্মতিতে সম্পাদিত হয়। নারীকে জোর করে বিবাহ দিলে তা প্রত্যাখ্যানের অধিকার তার রয়েছে। বিবাহ মূলত সহচরিতা, সহায়তা ও পরিবার গড়ার উদ্দেশ্যে, অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য নয়।
মহরের মর্যাদা
ইসলামী বিবাহের কেন্দ্রে রয়েছে মহর, যা কনের একান্ত অধিকার। বর এটি প্রদান করবে, কিন্তু তা কখনো ফেরত নেওয়া যাবে না। মহর নারীর নিরাপত্তা ও সম্মানের প্রতীক। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর স্ত্রীদের মহর প্রদান করেছেন এবং সরল ও সহজ বিবাহের ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর কন্যা ফাতিমার বিবাহেও উপহার ছিল অতি সাধারণ ও প্রতীকী—যা স্পষ্ট করে দেয় যে বিবাহ হওয়া উচিত সরল, নয় বোঝাস্বরূপ।
মুসলিম সমাজে পণপ্রথা
দুঃখজনকভাবে, ভারতের মুসলিম সমাজেও পণ প্রবেশ করেছে। স্বেচ্ছা উপহার আজ চাহিদায় পরিণত হয়েছে, যা নির্ধারিত হয় বরপক্ষের শিক্ষা বা সামাজিক মর্যাদা দিয়ে। দরিদ্র মুসলিম পরিবারও এতে পিষ্ট হচ্ছে, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে পণ-হেনস্তা ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে। স্পষ্ট বোঝা যায়, সংস্কৃতির চাপ অনেক সময় ধর্মীয় শিক্ষাকেও ছাপিয়ে যায়।
পরিবর্তনের পথ
সমাজ পরিবর্তনের শুরু হতে হবে ভেতর থেকে। মুসলিম সমাজকে ইসলামের মূলনীতিতে ফিরতে হবে, যেখানে পণের কোনো স্থান নেই, বরং মহরই নারীর অধিকার। নারীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে, পুরুষদের মহর ও দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে হবে। উত্তরাধিকার ও সম্পত্তির বণ্টন ইসলামী বিধান অনুসারে নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে নারীর শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে শোষণ প্রতিহত করা সম্ভব হবে। রাসূলুল্লাহর (সা.) সরলতা ও ন্যায়পরায়ণতার আদর্শ অনুসরণ করেই মুসলিমরা সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
ইতিহাসের শিক্ষা
পণ শুধু ভারতে নয়, প্রাচীন ইউরোপ ও এশিয়ার সমাজেও ছিল। একে কন্যার সম্পত্তির অংশ হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা সমাজে পণ বিলুপ্ত হয়েছে। গ্রিসসহ অনেক দেশে নগরায়ণ ও লিঙ্গ-ভূমিকায় পরিবর্তনের ফলে পণ-প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে।
ভারত ব্যতিক্রম, এখানে বরং পণ সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বড় কারণ দুটি:
১. জনসংখ্যার চাপ, ফলে বিবাহের সুযোগ কমে গেছে।
২. উচ্চ মর্যাদার প্রতি আকাঙ্ক্ষা (হাইপারগ্যামি), যেখানে পরিবারগুলো উচ্চশিক্ষিত, শহুরে ও কর্মরত পুরুষকে বর হিসেবে চাইছে এবং এজন্য বড় অঙ্কের পণ দিচ্ছে। এর ফলেই শহরেও পণের মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
পণ বিরোধী কণ্ঠ
আশার আলো
কিছু গবেষকের মতে, নগরায়ণ, নারীর শিক্ষা বৃদ্ধি এবং গ্রাম-শহর বিভাজন কমে গেলে ভারতে একদিন পণ হ্রাস পেতে পারে। তবে এটি সময়সাপেক্ষ। যতদিন না সমাজে কন্যারা স্বামীর ঘরে গিয়ে বসবাস করবে আর পুত্ররা বাবা-মায়ের সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে, ততদিন পণ-প্রথা টিকে থাকবে।
পণমুক্ত সমাজের জন্য করণীয়
শুধু আইন নয়, প্রয়োজন সামাজিক সংস্কার।
নারীর উত্তরাধিকার ও সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ে ও উপহার বর্জন করে সরলতা গ্রহণ করতে হবে।
ধর্মীয় ও সামাজিক নেতা স্পষ্টভাবে পণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন।
বিদ্যালয়ে ছোটবেলা থেকে লিঙ্গসমতার শিক্ষা দিতে হবে।
নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
পণ কেবল এক বিবাহ-প্রথা নয়; এটি বৈষম্য, লোভ ও শোষণের প্রতীক। এটি জীবন নষ্ট করে, পরিবার ধ্বংস করে এবং বিবাহের পবিত্রতাকে কলুষিত করে। আইন আছে, কিন্তু কার্যকর হবে না যদি না সমাজ বদলায়। শিক্ষা, সংস্কার, সমঅধিকার ও নারীর ক্ষমতায়ন, এই চার হাতিয়ারেই পণমুক্ত ভারত গড়া সম্ভব। মুসলিম সমাজ যদি প্রকৃত ইসলামী নীতির ওপর ফিরে আসে, মহর ও সরলতাকে মেনে চলে, তবে তারা পথপ্রদর্শক হতে পারে।
শুধুমাত্র তখনই পণ সত্যিকার অর্থে বিলুপ্ত হবে, আর নারীরা পাবে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সমঅধিকার।
( ড. উজমা খাতুন, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়)