দারুল-উলুম দেওবন্দ হয়ে উঠেছে উগ্র ইসলামি প্রবণতার বিরুদ্ধে ভারতের নরম শক্তি

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 8 d ago
দেওবন্দের দারুল-উলূমে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি
দেওবন্দের দারুল-উলূমে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি
 
অদিতি ভাদুড়ী

আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোল্লা আমির খান মুত্তাকির সাম্প্রতিক ভারত সফরের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ার বৃহত্তম ইসলামি মাদ্রাসা — দারুল-উলুম দেওবন্দ।এই বছরের মে মাসের শুরুতে আমি কাজাখস্তানের আস্তানায় তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমরা উর্দু ও হিন্দিতে কথা বলেছিলাম।

তিনি আমাকে বলেছিলেন যে ভারতের সফর করা তাঁর এক বড় ইচ্ছা, কারণ তাঁর অন্যতম স্বপ্ন ছিল দারুল-উলুম দেওবন্দ পরিদর্শন করা। তাই মুত্তাকির এই সফর আশ্চর্যের কিছু ছিল না।তালিবানদের অধিকাংশই পাকিস্তানের দারুল উলুম হাক্কানিয়া থেকে স্নাতক। তারা দেওবন্দে বহু শতাব্দী আগে স্থাপিত পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে। ফলে তাদের শিক্ষার মূল ধারাও দেওবন্দি মতাদর্শের অনুসারী।

দেওবন্দে সমবেত বিপুল জনসমাগম, তালেবান ও বহু আফগানের মধ্যে এই মাদ্রাসার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা — সবই প্রমাণ করে যে দেওবন্দের প্রভাব কতটা শক্তিশালী এবং বিশ্বজোড়া।এ কারণে দেওবন্দকে ভারতের নরম শক্তির (soft power) একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ধরা যেতে পারে। শুধু তালেবান নয়, বিশ্বজুড়ে বহু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সঙ্গে আলোচনার এক সেতু হিসেবেও এটি ভূমিকা রাখতে পারে।
 
প্রখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত মাওলানা কাসিম নানুতভি এবং রশিদ আহমদ গঙ্গোহী ১৮৬৬ সালে ইসলাম ধর্মের বিশুদ্ধ শিক্ষা পুনরুজ্জীবিত করতে এবং মুসলমান পরিচয় রক্ষা করতে দারুল-উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন।তখন ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন শেষ হতে বসেছে, মুসলিম সমাজ গভীর সংকট ও আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছিল।বিশ্বজুড়েও মুসলিম শক্তি দুর্বল হচ্ছিল — মধ্যপ্রাচ্যে উসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছে, ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে।

অনেক পণ্ডিতের বিশ্বাস, এই পতনের কারণ ছিল ইসলামি মূল্যবোধের অবক্ষয় ও বিদেশি সংস্কৃতি গ্রহণ।
দারুল-উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত ইসলামি শিক্ষা ও নৈতিক দিকনির্দেশনা প্রদান।
 
দারুল উলুম দেওবন্দ কম্পাউন্ড
 
এই সেমিনারি ইসলামের এক কঠোর, পিউরিটান (Puritan) ব্যাখ্যা অনুসরণ করে।এখানে নবী হযরত মুহাম্মদের (সা.) জন্মদিন উদযাপন করা হয় না; কেবল দুটি ঈদই ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়।

একই সঙ্গে, দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধেও এক প্রতিক্রিয়া।এটি শুধু আধ্যাত্মিক জাগরণ নয়, বরং এক ধরনের প্রতিরোধ আন্দোলনও ছিল।প্রতিষ্ঠানটি গভীরভাবে ঔপনিবেশিক-বিরোধী ও মুসলমান সমাজের আত্মপরিচয় এবং স্বাধীনতা রক্ষার আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নিয়েছিল।
 
২০১০ সালে আমি দারুল-উলুম দেওবন্দ পরিদর্শন করেছিলাম।৯/১১-র ঘটনার পর পাকিস্তানের দেওবন্দি স্কুল থেকে তালেবানের উত্থান নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখার উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিলাম।সেই সময়ে সেখানে প্রায় ৩,৫০০ ছাত্র পড়াশোনা করছিল।এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি এক লক্ষেরও বেশি স্নাতক তৈরি করেছে।প্রতি বছর ৮০০–১,০০০ ছাত্র এখান থেকে পড়া শেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেওবন্দি মতাদর্শ বহন করে নিয়ে যায়।

সেমিনারিটির অন্যতম বড় অবদান হলো এর ছাত্রদের বিনামূল্যে শিক্ষা, থাকা, খাওয়া ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান।ভবনগুলো সুন্দর ও বিশাল, তবে ছাত্রদের থাকার জায়গা ছিল বেশ সাদামাটা।ছাত্ররা মূলত ভারতের দরিদ্র পরিবারের সন্তান।বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং আরও কিছু মুসলিম দেশের শিক্ষার্থীরাও এখানে পড়াশোনা করে।
 
পাঠ্যক্রম তিন ভাগে বিভক্ত —প্রথম পাঁচ বছর মৌলিক শিক্ষা, যেখানে সামাজিক বিজ্ঞান, আরবি, হিন্দি, ইংরেজি ও উর্দু পড়ানো হয়।পরবর্তী সাত বছর ইসলামি আইন শিক্ষা (ফিকহ) — যা স্নাতক ডিগ্রির সমান।এরপর দুই বছরের বিশেষায়িত কোর্স থাকে ইসলামি বিচারশাস্ত্র, আরবি সাহিত্য বা যুক্তি নিয়ে।প্রাক্তন ছাত্ররা মদিনা ও ম্যানচেস্টারের মতো জায়গায় কাজ করেছে।

দেওবন্দের উপাচার্যের সহকারী আদনান উসমানি ব্যাখ্যা করেছিলেন —“আমাদের পাঠ্যক্রম এত জনপ্রিয় যে ভারত ও বিদেশের বহু ইসলামিক সেমিনারি এটি অনুসরণ করে।দেওবন্দ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এমন প্রতিষ্ঠান, যা পরবর্তী ধর্মীয় স্কুললের জন্য আদর্শ হয়ে ওঠে।প্রথমে অন্যান্য মাদ্রাসা তাদের প্রতিনিধি পাঠাত আমাদের কাছে পড়াশোনার জন্য, পরে আমাদের ছাত্ররাই গিয়ে অন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে।”
 
দারুল উলূম দেওবন্দে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে মাওলানা আরশাদ মাদনি
 
দেওবন্দে শৃঙ্খলা ছিল অত্যন্ত কঠোর। এখানে যৌথ (সহশিক্ষা) শিক্ষা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ —নারী শাখা নেই, নারী কর্মীও নেই।প্রতিদিনের রুটিন এমন ছিল —ভোর ৪টায় নামাজ দিয়ে দিন শুরু হয়, তারপর সকাল ১০.৩০ পর্যন্ত পাঠদান চলে।মধ্যাহ্নভোজের সময় ঘণ্টা বাজে, খাওয়া ও বিশ্রামের পর দুপুর ২টায় আবার নামাজ ও পড়াশোনা শুরু হয়।সন্ধ্যা ৫টায় নামাজের পর রাতের খাবার হয়, এরপর সন্ধ্যা ৭টায় আরেক দফা নামাজ, আলোচনা ও বিতর্ক হয়।রাত ৯টায় শেষ নামাজের মাধ্যমে দিন শেষ হয় এবং ছাত্ররা নিজ নিজ কক্ষে ফিরে যায়।

এখানে খেলাধুলা বা সংগীতের কোনো ব্যবস্থা নেই, টেলিভিশন দেখা নিষিদ্ধ।তবে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে —আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও মূল্যায়ন কর্তৃপক্ষকে কিছু পরিবর্তনের দিকে ভাবতে বাধ্য করেছে, যদিও ইসলামি পাঠ্যক্রম মূলত অপরিবর্তিতই রয়েছে।
 
২০০১ সালে ইংরেজি ভাষার কোর্স চালু করা হয়।যদিও ছাত্ররা মাত্র দুই বছর ইংরেজি শেখে, তবুও এই কোর্সের ফলে তারা অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে সক্ষম হয়।২০০০ সালে কম্পিউটার বিভাগও চালু হয়।
দেওবন্দের স্নাতক আব্দুল রহিম তখন সেই দায়িত্বে ছিলেন।এই একবছরের কোর্সে ছাত্রদের ডেস্কটপ পাবলিশিং, ফটোশপ, কোরেল অ্যাপ্লিকেশন, পেজমেকার এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর প্রেক্ষাপটে মিডিয়ার আগ্রহ বাড়ায় একটি সাংবাদিকতা অনুষদও প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সাত বছরের ইসলামিক আইন পড়ার পর ছাত্ররা আরও দুই বছর সাংবাদিকতা অধ্যয়ন করতে পারে।
ফলে দেওবন্দের ছাত্ররা শুধু ধর্মীয় নেতা নয়, নানা পেশার জন্যও প্রস্তুত হচ্ছে।
 
আফগানিস্তানে ১৯৮০–র দশকে দেওবন্দে অধ্যয়নরত সাংবাদিক জন বাট মুত্তাকির সফরের পর লিখেছিলেন:
“মাদ্রাসা স্নাতকদের জন্য পেশাগত বিকল্প থাকা দরকার।ভারতে যেমন শিক্ষাগত ও পেশাগত বিকল্প রয়েছে, আফগানিস্তানেও তেমন সুযোগ তৈরি হলে দেশ উপকৃত হবে।আফগান ছাত্রদের দেওবন্দে এসে পড়াশোনা করতেই হবে — এমন নয়;তালিবানরা এখন ক্ষমতায় থাকায় আফগান মাদ্রাসাগুলিও এই শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।”অর্থাৎ, আফগানিস্তান ভারতের কাছ থেকে শিক্ষা পেতে পারে কীভাবে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক দক্ষতা যুক্ত করা যায়।
 
দেওবন্দের প্রভাব ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বহু দূর গেছে।পাকিস্তানের হাক্কানিয়া মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্ঠানও দেওবন্দের পাঠ্যক্রম গ্রহণ করেছে,কিন্তু তা জিহাদি কারখানা হিসেবে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে।তার বিপরীতে, দেওবন্দ নিজেকে সন্ত্রাসবাদ ও রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ দূরে রেখেছে।এই সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনতার আগেই সচেতনভাবে নিয়েছিল।ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দারুল-উলুম দেওবন্দ দেশভাগের বিরোধিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

২০০৮ সালে, যখন সন্ত্রাসবাদ ছিল বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু,তখন দারুল-উলুম দেওবন্দ এক ঐতিহাসিক ফতোয়া জারি করে:“ইসলামে কোনো প্রকার সামাজিক অশান্তি সৃষ্টি করা, সংঘাত, রক্তপাত, লুণ্ঠন বা নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা — সবই অমানবিক অপরাধ।”
 
সংবাদমাধ্যমের মতে, প্রায় ৬০,০০০ ধর্মীয় নেতা এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছিলেন।দেওবন্দের প্রভাব এতটাই প্রবল যে তার মতামতকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়।দেশজুড়ে নানা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি — যেমন গরু হত্যা, তিন তালাক, নারী-পুরুষ একসঙ্গে নামাজ পড়া ইত্যাদি বিষয়ে — দারুল-উলুমের মতামত চান।এই বিপুল প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য একটি আলাদা বিভাগও তৈরি করা হয়েছে।
 
দেওবন্দ চাইলে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে পারে।তালেবান নেতাদের কাছে দেওবন্দের মর্যাদা সুস্পষ্ট।অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, দেওবন্দ তালেবানকে পাকিস্তানের প্রভাব থেকে ধর্মীয়ভাবে আলাদা করতে সাহায্য করতে পারে।ভারত যদি তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে, তাহলে আরও আফগান নেতা ভারতে সফর করবেন এবং দেওবন্দের নির্দেশাবলী তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানে মাদ্রাসাগুলোর রাজনীতি ও জিহাদের সংযোগ এক স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে —
তালেবানও সেই পরিবেশেই বড় হয়েছে।কিন্তু দেওবন্দ শেখাতে পারে কীভাবে ধর্মকে রাজনীতি ও সহিংসতা থেকে আলাদা রাখা যায়।
 
দেওবন্দ ভারতের ইসলামি ঐতিহ্যের একটি বিশেষ ধারা প্রতিনিধিত্ব করে।তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে এটি ভারত ও আফগানিস্তানকে এক আধ্যাত্মিক বন্ধনে যুক্ত করতে পারে।তালেবানরা দেওবন্দের নির্দেশনা মেনে চললে, উভয় দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হতে পারে।
 
দারুল-উলুম দেওবন্দের প্রগতিশীল দিকনির্দেশনা আফগানিস্তানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারে —এবং একই সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানটি কেবল এশিয়ার বৃহত্তম ইসলামি সেমিনারি নয়,বরং সমাজে একটি প্রগতিশীল ও মানবিক ভূমিকা পালনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।