শান্তিপ্রিয় রায়চৌধুরী:
ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণকারী বাংলা কথাসাহিত্যে বিমল কর অতি পরিচিত এবং জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। চল্লিশের মাঝামাঝি তাঁর উত্থান আর পঞ্চাশের দশকে একজন গল্পকার হিসেবে পাঠকদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর লেখনী ছিল ক্ষুরধার। তাঁর বিভিন্ন গল্প উপন্যাসে ফুটে উঠেছে সমকালীন সময়, সমাজ, রাজনীতি।
দীর্ঘ এই সাহিত্যজীবনে কেমন লিখতেন বিমল কর?
দেশ' পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগের সাগরময় ঘোষ সেই সময় তাঁর লেখা সম্পর্কে বলেছিলেন, "বিমল করের যে-কোন গল্পের মধ্যেই আমরা তার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই। তাঁর ভাষার বৈশিষ্ট্যও তাঁকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দেয়। তাঁর গল্পের বিষয় ও ভাষা নিপুণ চিত্রশিল্পীর চিন্তা ও রঙের মতন, যা সমানভাবে মিলে এক আশ্চর্য সৃষ্টি হয়ে ওঠে। মানুষের মনের মধ্যে ডুব দিয়ে তিনি তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করে তার দর্পণটি তুলে ধরেন, তাতে আমরা সকলেই নিজেদের দেখতে পাই।"
বিমল করের লেখা অসংখ্য উপন্যাস ও ছোটগল্প রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো -উপন্যাস: 'অসময়' (১৯৭৫ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত), 'হ্রদ', 'দেওয়াল', 'ভুবনেশ্বরী', 'এক অভিনেতার মৃত্যু'। ছোটগল্প: তাঁর অনেক ছোটগল্প রয়েছে, যার মধ্যে 'খিল' এবং 'ওরা' উল্লেখযোগ্য। কিশোর উপন্যাস: তাঁর লেখা রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ, যেমন 'তুরুপের শেষ তাস', 'সোনার ঘড়ির খোঁজে' এবং 'হায়দার লেনের ১৩ নাম্বার বাড়ীর কফিন বাক্স' কিশোরদের জন্য জনপ্রিয়।
১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তার রচিত প্রথম ছোটগল্প অম্বিকানাথের মুক্তি প্রবর্তক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তার রচিত ছোটগল্প সংকলন বরফ সাহেবের মেয়ে প্রকাশিত হয় । সেই বছরেই দেশ পত্রিকার বিভাগীয় প্রধান হিসাবে যোগ দেন। এই পদে তিনি ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ছিলেন। এর আগে সহ সম্পাদক হিসাবে তিনি পশ্চিমবঙ্গ ও সত্যযুগ পত্রিকায় কাজ করেন।
তার রচিত বেশ কয়েকটি কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। যেমন বসন্ত বিলাপ, হ্রদ ( চলচ্চিত্র), বালিকা বধূ, (যেটি হিন্দিতেও নির্মিত হয়েছিল) যদুবংশ, ছুটি (এটি তৈরি হয়েছিল তার খড়কুটো উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে)।
সাহিত্য সাধনার জন্য তিনি পেয়েছেন বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। এ ছাড়াও পেয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র পুরস্কার, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহ দাস পুরস্কার। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দুবার।
তিনি উত্তর ২৪ পরগণার টাকীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জ্যোতিষচন্দ্র কর এবং মাতা নিশিবালা কর। তিনি জব্বলপুর, হাজারিবাগ, ধানবাদ, আসানসোল প্রভৃতি জায়গায় ছোটবেলা কাটিয়েছেন। তিনি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তারপর আসানসোল অ্যামিউনেশন প্রোডাকশন ডিপোয় এআরপি হিসাবে কর্মজীবনের শুরু হয় ।
বিমল কর অসময় উপন্যাসের জন্য ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য একাদেমী পুরস্কার এছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র পুরস্কার, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহ দাস পুরস্কার পান। তিনি দুবার আনন্দ পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তিনি বহু ছোটগল্প এবং কিশোর উপন্যাসও লিখেছিলেন।২০০৩ সালের ২৬ আগস্ট বিমল কর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।বিমল কর ৮২ বছর বয়েসে তাঁর বিধাননগরের বাসভবনে মারা যান।
আজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্রের জন্মদিন। ১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর জন্মশতবর্ষ পালিত হয়। আজও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্রের লেখা পাঠক মহলে মনের মনি কোঠায় ছুয়ে আছে।