শান্তি প্রিয় রায়চৌধুরী:
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ যখন মধ্য গগনে তখন শরৎচন্দ্রের জ্যোতি ছড়িয়ে পড়েছিল তাদেরই উদ্দেশ্যে "সংসারে যারা শুধু দিল, পেল না কিছুই। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পর যে নামটি আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিল তিনি হলেন কথাসাহিত্যের অমরস্রষ্টা,অপরাজেয় জীবন-শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি আজও আমাদের হৃদয়ে রয়েছেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) বিংশ শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত বাঙালি ঔপন্যাসিক ও গল্পকার ছিলেন।
'অপরাজেয় কথাশিল্পী’ হিসেবে খ্যাত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। খ্যাতিমান বাঙ্গালী লেখক ও ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৬ সালে হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
এই অমর কথা শিল্পীর অসংখ্য উপন্যাস, ভারত বর্ষের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বিখ্যাত উপন্যাস গুলোর মধ্যে রয়েছে-বড়দিদি(১৯১৩), পল্লীসমাজ(১৯১৬), দেবদাস(১৯১৭), চরিত্রহীন(১৯১৭), শ্রীকান্ত(চারখন্ড ১৯১৭-১৯৩৩), দত্তা(১৯১৮), গৃহদাহ(১৯২০), পথের দাবী(১৯২৬), পরিণীতা(১৯১৪), শেষ প্রশ্ন(১৯৩১) ইত্যাদি। তিনি তাঁর কালজয়ী উপন্যাস, গল্পে নানা উক্তি করে গিয়েছেন যা আজো আমাদের পাথেয়।
এই অমর কথাশিল্পীর উপন্যাসের মূল বিষয় ছিল পল্লীর জীবন ও সমাজ। তারই রূপচিত্র এঁকেছেন তিনি তাঁর রচনায়। গ্রামের অবহেলিত ও বঞ্চিত বাঙালি নারীর প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধা ছিল তুলনাহীন। সামাজিক বৈষম্য, কুসংস্কার ও শাস্ত্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাহিনী নির্মাণে তার ছিল অসামান্য কুশলতা, এবং অতি সাবলীল ভাষা তাঁর কথাসাহিত্যের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির প্রধান কারণ। বাংলা সহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় তাঁর অনেক উপন্যাসের চিত্রনাট্য নির্মিত হয়েছে এবং সেগুলি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে, যথা: দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি। কথাসাহিত্যিক চিত্রাঙ্কনেও দক্ষ ছিলেন। বার্মায় বসবাসকালে তাঁর অঙ্কিত ‘মহাশ্বেতা’ অয়েল পেইন্টিং একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম।
শরৎচন্দ্র তার সাহিত্য কীর্তির জন্য অনেক সম্মান লাভ করেছেন। শরৎচন্দ্র কুন্তলীন পুরস্কার (১৯০৩), জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯২৩), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্যপদ (১৯৩৪) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি (১৯৩৬) লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় এই মরমী লেখকের মহাপ্রয়াণ ঘটে।
১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শুধুমাত্র একজন সাহিত্যিক নন, তিনি ছিলেন এক সমাজ-সংস্কারক। তার লেখায় মেলে সমাজের আয়না—যেখানে আমরা দেখি অসাম্য, কষ্ট, প্রেম, সংগ্রাম ও মানুষ হওয়ার গল্প। তার সাহিত্য যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক, কারণ তার লেখায় রয়েছে চিরন্তন মানবিক সত্য।