বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড , অনুপ্রেরণা পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 6 d ago
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ 

তিনি একাধারে সংস্কৃত পন্ডিত, লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, জনহিতৈষী। তিনি ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র এবং ১৮৩৯ সালের মধ্যেই বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। তাছাড়া প্রতি বছরই তিনি বৃত্তি এবং গ্রন্থ ও আর্থিক পুরস্কার পান। তিনি হলেন আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
 
১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করার অল্প পরেই তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান পন্ডিতের পদ লাভ করেন। ১৮৪৬ সালের এপ্রিল মাসে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উক্ত কলেজের শিক্ষকগণের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের কাজে ইস্তফা দেন এবং ১৮৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরের মাসে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।
 
অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি কলেজের অনেক সংস্কার করেন। এর আগে এ কলেজে পড়ার অধিকার ছিল কেবল ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্য ছাত্রদের, কিন্তু তিনি সব শ্রেণির হিন্দুদের জন্যে কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করেন। তিনি কলেজে পড়ার জন্যে নামেমাত্র বেতন চালু করেন এবং প্রতিপদ ও অষ্টমীর বদলে রবিবার সপ্তাহিক ছুটি চালু করেন। কলেজের ডিগ্রি নিয়ে যাতে ছাত্ররা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ লাভ করতে পারে, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি সে প্রতিশ্রুতিও আদায় করেন। কিন্তু তিনি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনেন কলেজের পাঠ্যক্রমে। পূর্বে ব্যাকরণ এবং বীজগণিত ও গণিত শেখানো হতো সংস্কৃতে, কিন্তু তিনি সংস্কৃতের বদলে ব্যাকরণ বাংলার মাধ্যমে এবং গণিত ইংরেজির মাধ্যমে পড়ানোর নিয়ম চালু করেন। ইংরেজি ভাষা শেখাকে তিনি বাধ্যতামূলক করেন এবং ইংরেজি বিভাগকে উন্নত করেন। বাংলা শিক্ষার ওপরও তিনি জোর দেন। তবে তারচেয়ে ব্যাপক পরিবর্তন করেন দর্শন পাঠ্যক্রমে। তিনি সাংখ্য এবং বেদান্ত দর্শনকে ভ্রান্ত এবং প্রাচীনপন্থী বলে বিবেচনা করতেন। সে জন্যে, তিনি বার্কলের দর্শন এবং অনুরূপ পাশ্চাত্য দর্শন শিক্ষাদানের বিরোধিতা করেন এবং তার পরিবর্তে বেকনের দর্শন এবং জন স্টুয়ার্ট মিলের তর্কশাস্ত্র পড়ানোর সুপারিশ করেন। অনেকে তাঁর সমালোচনা করলেও, তাঁর এ সংস্কার ছিল সুদূরপ্রসারী এবং শিক্ষা পরিষদ তাঁর এ সংস্কারের প্রশংসা করে এবং পুরস্কারস্বরূপ ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর বেতন বৃদ্ধি করে।
 
১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ গৃহীত হওয়ার পর সরকার গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশে ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের অতিরিক্ত সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুর জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। দুবছরের মধ্যে তিনি এ রকমের বিশটি স্কুল স্থাপন করেন। এছাড়া তিনি এসব স্কুলে পড়ানোর জন্যে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন। তিনি নিজ গ্রামে নিজ খরচে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
 
 তখন রক্ষণশীল সমাজ মনে করতো যে, স্ত্রীশিক্ষা দেওয়া নিষিদ্ধ।  অন্যদিকে, বিদ্যাসাগর ছিলেন স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ সমর্থক। সরকার সেজন্যে এ কাজের দায়িত্ব দেয় তাঁর ওপর। তিনি বালিকা বিদ্যালয় খোলার বিষয়ে স্থানীয় লোকদের সমর্থনে বর্ধমানে একটি স্কুল স্থাপন করেন। পরে ১৮৫৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে আরও পঁয়ত্রিশটি স্কুল স্থাপন করতে সমর্থ হন।  এ সময়ে তিনি বেথুন সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হন। এই সোসাইটির কাজ ছিল স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার এবং পরিবার ও সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধির। তিনি স্কুল স্থাপনের জন্যে ধনী জমিদারদেরও উৎসাহ প্রদান করেন।
 
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
 
ধনী পরিবারের ছেলেদের ইংরেজি শেখানোর উদ্দেশে ১৮৫৯ সালে কলকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন স্থাপিত হয়। কিন্তু দুবছরের মধ্যে এ স্কুল বন্ধের উপক্রম হলে বিদ্যাসাগর এ স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৮৬৪ সালে তিনি এর নাম রাখেন হিন্দু মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউট। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে তিনি এ স্কুলে এন্ট্রেন্স পরীক্ষার জন্য ছাত্রদের শিক্ষা দিতে থাকেন এবং ক্রমান্বয়ে সাফল্য লাভ করেন। ১৮৭২ সালের গোড়ার দিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিদ্যালয়কে কলেজ এবং ১৮৭৯ সালে ডিগ্রি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
 
সংস্কৃত কলেজের সংস্কার ও আধুনিকীকরণ এবং বাংলা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশ করা। বর্ণপরিচয় (১৮৫১) প্রকাশের আগ পর্যন্ত প্রথম শিক্ষার্থীদের জন্যে এ রকমের কোনো আদর্শ পাঠ্যপুস্তক ছিল না। তাঁর বর্ণপরিচয়ের মান এতো উন্নত ছিল যে, প্রকাশের পর থেকে অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত এই গ্রন্থ বঙ্গদেশের সবার জন্যে পাঠ্য ছিলো। দেড়শো বছর পরেও এখনও এ গ্রন্থ মুদ্রিত হয়। বর্ণপরিচয়ের মতো সমান সাফল্য লাভ করেছিল বোধোদয় (১৮৫১), কথামালা (১৮৫৬), চরিতাবলী (১৮৫৬) এবং জীবনচরিত (১৮৫৯)। সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ও (১৮৫১) বর্ণপরিচয়ের মতো অভিনব— এর আগে বাংলা ভাষায় কোনো সংস্কৃত ব্যাকরণ ছিল না। চার খন্ডে লেখা ব্যাকরণ-কৌমুদীও (১৮৫৩-৬৩) তাঁর ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অবদান।
তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তিনি কেবল লেখাপড়া শেখানোর কৌশল হিসেবে এগুলি লেখেননি, বরং ছাত্রদের নীতিবোধ উন্নত করা এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানও তাঁর লক্ষ্য ছিল। যেমন চরিতমালায় তিনি প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিদের জীবনী লেখেননি, বরং ইউরোপের ষোলোজন বিখ্যাত ব্যক্তির পরিচিতি দিয়েছেন। তেমনি জীবনচরিতে তিনি কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন এবং হার্শেলের মতো বিজ্ঞানীদের এবং উইলিয়ম জোনসের মতো পন্ডিত ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচিতি লিখেছেন। নীতিবোধেও একই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। এতে তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্ম এবং আচার-অনুষ্ঠানের কোনো উল্লেখ করেননি, বরং যেসব নীতিবোধ সকল মানুষের থাকা উচিত, তার কথা লিখেছেন। কথামালায় তিনি নীতিমূলক গল্প সংগ্রহ করেছেন। আর তিন খন্ড আখ্যানমঞ্জরীতে সংগ্রহ করেছেন ইউরোপ-অ্যামেরিকার (এবং চারটি আরব দেশ ও পারস্যের) সত্যিকার এবং জনপ্রিয় গল্প। এসব গল্পের শিরোনাম—মাতৃভক্তি, পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃস্নেহ, গুরুভক্তি, আতিথেয়তা, পরোপকার এবং সাধুতার পুরস্কার—থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি কেবল ছাত্রদের নীতিবোধ উন্নত করতে চাননি, সেই সঙ্গে চেয়েছিলেন তাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে।তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি দীর্ঘদিন বঙ্গদেশের সর্বত্র পাঠ্য ছিল। এগুলোর মাধ্যমে তিনি একই সঙ্গে প্রামাণ্য ভাষা ও বানান যেমন শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন, তেমনি পেরেছিলেন নীতিবোধ উন্নত করতে। তিনি কেবল পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে নয়, বরং তাঁর অন্যান্য রচনা দিয়েও বাংলা গদ্যের সংস্কার এবং তার মান উন্নত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পন্ডিতগণ এবং রামমোহন রায় যে বাংলা গদ্যরীতি নির্মাণ করেছিলেন, তা ছিল আড়ষ্ট, কৃত্রিম এবং কোনোমতে ভাব প্রকাশের উপযোগী। তাঁর আগেকার গদ্যে তথ্য প্রকাশের মতো শব্দাবলী ছিল কিন্তু তাতে এমন সৌন্দর্য, সাবলীলতা এবং গতির স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না, যাকে সাহিত্যিক গদ্য বলা যায় বা যা দিয়ে সাহিত্য রচনা করা যায়।
 
১৮৪৭ সালে বেতালপঞ্চবিংশতি প্রকাশের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর তা পাল্টে দিলেন। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের শব্দ-সাযুজ্য আবিষ্কার, বাক্য-কাঠামো সংস্কার, কর্তা ও ক্রিয়াপদ এবং ক্রিয়া ও কর্মের মধ্যে যথাযথ অন্বয় স্থাপন করে বাংলা গদ্যকে মাধুর্য দান করেন। তাছাড়া, শ্বাস-যতি ও অর্থ-যতির সমন্বয় ঘটান এবং পাঠক যাতে তা সহজেই দেখতে পান, তার জন্যে ইংরেজি রীতির যতিচিহ্ন, বিশেষ করে কমা, ব্যবহার করেন। তাঁর আগে একমাত্র অক্ষয়কুমার দত্তই ইংরেজি যতিচিহ্ন সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করেছিলেন।
অবশ্য তিনি একই গদ্যরীতিতে তাঁর সব রচনা লেখেননি, তিনি পাঠ্যপুস্তক যে-রীতিতে লিখেছেন, সাহিত্য রচনা করেছেন তা থেকে ভিন্ন ভঙ্গিতে; আবার তাঁর বেনামী পুস্তকগুলির রীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন রীতির—তা পরিপূর্ণ হাস্যরস এবং ব্যঙ্গবিদ্রূপে।
 
তাঁর প্রথম সাহিত্যগ্রন্থ বেতালপঞ্চবিংশতিতেই বিদ্যাসাগর প্রমাণ দিয়েছেন, তিনি কেবল বেতালের গল্পগুলিকেই নতুন করে বলেছেন, অনুবাদ করেননি। গল্পগুলি বলতে গিয়ে তিনি তাদের সংস্কার এবং পরিবর্তন করেছেন এবং মূল বেতালের স্থূল রুচি ত্যাগ করে তাদের আধুনিক পাঠকদের কাছে পরিবেশনের উপযোগী করে তুলেছেন। একই কথা বলা যায় কালিদাসের রচনা অবলম্বনে রচিত শকুন্তলা (১৮৫৪) সম্পর্কে। তাছাড়া এ গ্রন্থে তিনি শকুন্তলা এবং তার দুই সখীকে রীতিমতো বাঙালি নারীর মতো করে নির্মাণ করেছেন। সীতার বনবাসের (১৮৬০) সীতাও নিতান্ত বাঙালি নারী হয়ে উঠেছেন। এমনকি তিনি যখন ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯) নাম দিয়ে শেক্সপীয়রের কমেডি অব এরর্সের অনুবাদ করেছেন, তখন তাকে বাঙালি পরিবেশের উপযুক্ত করে রচনা করেছেন। তদুপরি তাঁর ভ্রান্তিবিলাস গল্প, নাটক নয়। তাঁর ভাষাভঙ্গি, সূক্ষ্ম হাস্যরস এবং শব্দের মারপ্যাঁচে এই দুটি গ্রন্থকেই অনুবাদ নয়, বরং মৌলিক গ্রন্থ বলে মনে হয়। তাঁর গদ্যে তিনি অনুপ্রাসসহ সঙ্গীতময় এবং বিষয়ের উপযোগী শব্দ ব্যবহার করেছেন। শ্বাসযতি ও অর্থযতির সমন্বয় ঘটানোর ফলে তাঁর গদ্যে এমন সৌন্দর্য এসেছে যা তাঁর পূর্ববতী লেখকরা আবিষ্কার করতে পারেননি।
 
তিনি ছিলেন আধুনিক মনোভাবাপন্ন। তিনি উপলব্ধি করেছেন, পুরোনো মূল্যবোধ এবং পরিবারের ভেতর থেকে পরিবর্তন আনতে না পারলে সমাজ এবং দেশের কখনো প্রকৃত উন্নতি হবে না। এ জন্যে তিনি বিধবা-বিবাহ চালু করা, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা এবং স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের জন্যে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন।তাঁর সংস্কৃত কলেজ ছাড়ার কয়েক মাস পরে বিধবাদের পুনর্বিবাহের পক্ষে তাঁর প্রথম বেনামী লেখা প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালের এপ্রিল মাসে বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকায়। আর এ বিষয়ে তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে, দ্বিতীয় গ্রন্থ অক্টোবর মাসে। এভাবে বিধবাবিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ দেওয়া ছাড়াও, বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রবর্তনের পক্ষে একটি আইন প্রণয়নের জন্যে তিনি সামাজিক আন্দোলন আরম্ভ করেন। সেই মাসেরই ৪ তারিখে তিনি এর পক্ষে বহু স্বাক্ষরসংবলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠান। পরে এরকমের আরও ২৪টি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠানো হয়। অনেকগুলি আবেদনপত্র আসে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল থেকে। এসব আবেদনপত্রে প্রায় পঁচিশ হাজার স্বাক্ষর ছিল। অপরপক্ষে, রক্ষণশীল সমাজ আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করে সরকারের কাছে আঠাশটি আবেদনপত্র পাঠান। তাঁদের যুক্তি ছিল যে, এরকমের আইন পাস করে দেশবাসীর ধর্মে হস্তক্ষেপ করা সরকারের পক্ষে উচিত হবে না। এতে স্বাক্ষর ছিল পঞ্চান্ন হাজারেরও বেশি। বিরোধীদের পক্ষেই পাল্লা ভারী ছিল, তা সত্ত্বেও ১৮৫৬ সালের জুলাই মাসে বিধবাবিবাহ আইন প্রণীত হয়।
 
বিদ্যাসাগর এবং তাঁর বন্ধুরা মিলে ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে রক্ষণশীল সমাজের বিক্ষোভ এবং প্রচন্ড বাধার মুখে ঘটা করে এক বিধবার বিবাহ দেন। পাত্র ছিল সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের একজন সহকর্মী। তাছাড়া নিজের একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়নে সাফল্য লাভ করায় পরে কুলীনদের বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ আইন পাস করার পক্ষে সরকারের কাছে আবেদন জানান।
 
তাঁর দয়া এবং মানবিকতার জন্যে তিনি করুণাসাগর নামে পরিচিতি পান (তাঁকে এ বিশেষণ প্রথমে দিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত)। তিনি তাঁর দান এবং দয়ার জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি ঐতিহ্যিক এবং রক্ষণশীল পরিবারে এবং সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি যুক্তিও দিতেন হিন্দু শাস্ত্র থেকে; কিন্তু তিনি ছিলেন ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দিহান মনের। তাঁর বোধোদয় গ্রন্থ যেমন তিনি শুরু করেছেন পদার্থের সংজ্ঞা দিয়ে। পরে সংজ্ঞা দিয়েছেন ঈশ্বরের, যাঁকে তিনি বলেছেন সর্বশক্তিমান, সর্বত্রবিরাজমান চৈতন্যস্বরূপ। পরে এ গ্রন্থে তিনি যা কিছু দেখা যায়, স্পর্শ করা যায়, অনুভব করা যায়, তেমন সব বিষয়ের সংজ্ঞা দিয়েছেন; কিন্তু ঈশ্বর বা কোনো অতিলৌকিক শক্তির নামও উল্লেখ করেননি।
 
সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করার সময় ১৮৫৫ সালে সরকার তাঁকে হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও নদীয়া জেলার বিশেষ স্কুল পরিদর্শকের (Special Inspector of Schools) অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করে। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি (কলকাতা) ও বেথুন সোসাইটিসহ আরও কিছু সংগঠনের সম্মানিত সভ্য ছিলেন। ১৮৫৮ সালে যাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ফেলো নির্বাচিত হন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ইম্পেরিয়াল অ্যাসেমব্লিজ-এ সম্মাননা-সনদ লাভ করেন এবং ১৮৮০ সালের জানুয়ারিতে সি.আই.ই (CIE) হন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন লাভ করেন। তাঁর মৃত্যু হয় ২৯ জুলাই, ১৮৯১ সালে।  
 
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন কেবল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পথিকৃৎ নন, তিনি ছিলেন সমাজসংস্কারক, মানবতাবাদী ও শিক্ষা বিস্তারের এক অক্লান্ত যোদ্ধা। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা নারীশিক্ষার প্রসার, বিধবা পুনর্বিবাহ প্রবর্তন ও সমাজে কুসংস্কার দূরীকরণে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল। বিদ্যাসাগর কেবল ইতিহাসের এক মহান ব্যক্তি নন, আমাদের পথ চলার প্রেরণাও।