স্ক্রিন যুগে শিক্ষা ও উগ্রপন্থা নিরসনের চ্যালেঞ্জ

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 2 d ago
 পাহালগাম সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে দিল্লির চিকিৎসক ও চিকিৎসা পেশাদাররা
পাহালগাম সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে দিল্লির চিকিৎসক ও চিকিৎসা পেশাদাররা
 
সাবিহা ফাতিমা বেগম

১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচ। হনুক্কা উদ্‌যাপনের সময় হায়দরাবাদ-উৎসভূমির বাবা–ছেলে সাজিদ ও নাভিদ আক্রম অগ্নিবর্ষণ করে ১৫ জন ইহুদিকে হত্যা করে। ফিলিপাইনে ভ্রমণের সময় আইএসআইএস-ঘনিষ্ঠ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উগ্রপন্থায় দীক্ষিত হয়ে ওঠা এই জুটি অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ইহুদি-বিদ্বেষী হামলার ছাপ রেখে যায়।
 
এর আগেই, ২২ এপ্রিল ২০২৫, কাশ্মীরের পাহালগাম। লস্কর-ই-তৈয়বার সহযোগী সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টের জঙ্গিরা হিন্দু পর্যটকদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র মুহূর্তে পরিণত হয় রক্তাক্ত হিংসার মঞ্চে। দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্নতাবাদী টানাপোড়েন কীভাবে দৈনন্দিন জীবন, সংস্কৃতি ও সহাবস্থানের অনুভূতিকে আঘাত করে, এই ঘটনা তারই নির্মম প্রমাণ।
 
ভোপালে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম মহিলাদের প্রতিবাদ জানানোর এক দৃশ্য
 
সাত মাস পর, ১০ নভেম্বর, দিল্লির লালকেল্লার কাছে। কাশ্মীরের এক চিকিৎসক উমর উন নবি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বোঝাই গাড়ি জনবহুল বাজারে ঢুকিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। আত্মঘাতী হামলাকারীসহ ১৫ জন নিহত, আহত ২০ জন। জইশ-ই-মোহাম্মদের সঙ্গে যুক্ত এই ঘটনার পেছনে ছিল অনলাইন উগ্রপন্থায় প্রভাবিত হওয়ার পথ। উমরের কাহিনি দেখায় ‘ব্যক্তিগত উগ্রপন্থায়ন’, সংঘাতক্ষেত্র থেকে দূরে থেকেও কীভাবে এক শিক্ষিত পেশাজীবী নিজের বিশ্বাসের টানে হিংসার পথে হাঁটে।
 
এই ঘটনাগুলির সুতোর টান এক জায়গায়, ব্যক্তিগত উগ্রপন্থায়ন। মতাদর্শের আকর্ষণে গড়ে ওঠা মন অনিশ্চিতভাবে সমাজকে নাড়িয়ে দেয়। আর এটিও সত্য, এই প্রবণতা কোনো এক গোষ্ঠীতেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতে হিন্দু উগ্রপন্থার উত্থানও স্পষ্ট। আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট (ACLED)-এর এপ্রিল ২০২৪ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মাঝামাঝি সময়ে মুসলিমদের লক্ষ্য করে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হিংসার ২২ শতাংশের পেছনে ছিল গোরক্ষার নামে উসকানি।
 
ধাঁচ এক, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিকৃত আখ্যান, বাছাই করা ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি, ‘আমরা বনাম তারা’ বিভাজন। অভিযোগ–অভিমান যখন কঠোর বিশ্বাসের সঙ্গে মিশে যায়, তখন ধর্ম শক্তিতে রূপ নেয়। শিক্ষা, অনলাইন পরিসর, রাজনীতি ও ধর্মীয় পরিমণ্ডল, সব মিলেই এই প্রক্রিয়া গড়ে ওঠে। তাই আগুন জ্বলার আগেই শিকড় বোঝা জরুরি।
 
 
উগ্রপন্থায়ন মানে ধর্মীয় ধারণাকে এমন চরমে বাঁকানো, যেখানে ঘৃণা বা হিংসা ‘অনুমোদন’ পায়। কিছু মুসলিম প্রেক্ষাপটে এটি মূল শিক্ষার ফল নয়; বরং অর্থনৈতিক চাপ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর অল্পজানা মানুষদের কর্তৃত্বের দাবি, এসবের সমষ্টি। বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার বানিয়ে ইসলামের দয়া, সংযম ও সীমারেখা আড়াল করা হয়। ধর্ম রাজনীতিকরণে পরিচয় শক্ত হয়, মানবিকতা ক্ষীণ হয়।
 
২২শে এপ্রিল সন্ত্রাসবাদী হামলার পর বৈসরান (পাহালগাম)
 
কিন্তু কুরআন স্পষ্ট সীমা টানে। “ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই” (২:২৫৬) স্বাধীনতার ঘোষণা। “তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার” (১০৯:৬), পার্থক্যের সম্মান। অন্যের উপাস্যকে গালি নিষেধ: “তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ডাকে, তাদের অপমান কোরো না, তাহলে তারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে অপমান করবে” (৬:১০৮)।
 
‘কাফির’ শব্দটি প্রায়ই গালির মতো ছোড়া হয়, যা হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিমদের আহত করে। অথচ এটি একটি নিরপেক্ষ ধর্মতাত্ত্বিক পরিভাষা। তড়িঘড়ি বিচার নিষেধ: “হে মুমিনগণ, যে তোমাদের শান্তির প্রস্তাব দেয় তাকে ‘তুমি মুমিন নও’ বলো না” (৪:৯৪)। আর, “পরস্পরকে অপমান কোরো না, কটূনামেও ডাকো না” (৪৯:১১)। চরমপন্থা জন্মায় এই পাঠ্যগুলির অপব্যবহার থেকে। প্রকৃত ইসলাম নম্রতা, ন্যায় ও সহাবস্থান শেখায়, যা সাউন্ডবাইটে সঙ্কুচিত হলে হারিয়ে যায়।
 
 
মাদ্রাসা প্রসঙ্গ এই আলোচনায় বারবার আসে, বিশেষত বাড়তে থাকা মেরুকরণের প্রেক্ষিতে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ২৪,০১০টি মাদ্রাসা রয়েছে, এর মধ্যে ১৯,১৩২টি স্বীকৃত ও ৪,৮৭৮টি অস্বীকৃত। উত্তরপ্রদেশে সংখ্যা সর্বাধিক: ১১,৬২১টি স্বীকৃত ও ২,৯০৭টি অস্বীকৃত।
 
 
উত্তর ভারতে প্রায়ই এগুলোকে উগ্রপন্থার আঁতুড়ঘর বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, বৈচিত্র্য উপেক্ষা করে। উন্নয়নের নামে নিয়ন্ত্রণ, অর্থছাঁট বা কাঠামোগত সংস্কার কখনও প্রতিরোধ ও বিভাজন বাড়ায়। অথচ দারুল উলুম দেওবন্দের মতো প্রতিষ্ঠান যুগের পর যুগ নৈতিকতা ও সামাজিক বোধে সমৃদ্ধ আলেম তৈরি করেছে। পাশাপাশি আছে অর্থাভাব, পুরোনো পাঠ্যক্রম ও আধুনিক সংযোগহীন মাদ্রাসা, যা সার্বিকীকরণের ফাঁদে সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দক্ষিণ ভারতে উত্তরাঞ্চলের ক্ষয়িষ্ণু কেন্দ্র থেকে আসা মৌলভিদের ঢল ছোট মাদ্রাসাগুলির ওপর চাপ বাড়িয়েছে।
 
অস্ট্রেলিয়ার বন্ডি সমুদ্র সৈকতে সন্ত্রাসী হামলার স্থানের চারপাশে পুলিশ টহল দেওয়ার একটি ছবি
 
সমালোচনামূলক চিন্তা, ভাষা ও নাগরিক শিক্ষার ঘাটতিতে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় জ্ঞান পেলেও বৃহত্তর সমাজে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খায়, এতে দৃঢ়তা জন্মায়, যা পাহালগাম বা দিল্লির মতো হিংসার পেছনের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পথে ঠেলে দিতে পারে। যদিও অধিকাংশ মাদ্রাসাই মধ্যপন্থী। ওয়েস্ট পয়েন্টের কমব্যাটিং টেররিজম সেন্টারের (তারিখহীন) বিশ্লেষণ বলছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, ইন্দোনেশিয়ায় ১৪,০০০টির মধ্যে মাত্র ৩০টির মতো, ৫ শতাংশেরও কম চরমপন্থার সঙ্গে যুক্ত।
 
অতএব সমস্যা মাদ্রাসা নয়; সমস্যা মানের অসমতা, রাজনীতিকরণ ও থমকে থাকা সংস্কার। বিচ্ছিন্ন হলে তারা আরও অন্তর্মুখী হয়। সমাধান, উন্মুক্ততা, গভীরতা ও বৃহত্তর শিক্ষার সঙ্গে সেতুবন্ধ। উত্তরপ্রদেশের ২০২৩–২০২৫ উদ্যোগে স্বীকৃত মাদ্রাসায় দশম শ্রেণি পর্যন্ত হিন্দি ও ইংরেজি, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার ল্যাব বাধ্যতামূলক, এনসিইআরটি মানের সঙ্গে সাযুজ্যের লক্ষ্যে। ২০২২–২৩-এর সমীক্ষায় ২৫,০০০ প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত হলেও অর্থছাঁট অগ্রগতিকে ধীর করেছে।
 
ডিজিটাল টুল নীরবে চিত্র বদলাচ্ছে। বৈশ্বিক আলেমদের বক্তৃতা, পাঠ্য ও আলোচনায় অনলাইন প্রবেশাধিকার তরুণদের প্রথাগত ‘গেটকিপার’ এড়িয়ে যেতে সাহায্য করছে। জেন জি ও আলফা, মেরুকৃত দুনিয়ায় সংগঠিত ধর্ম নিয়ে সংশয়ী, নিজস্ব বাছাইয়ে অনুসন্ধান করে, সূত্র যাচাই করে, প্রশ্ন তোলে। বিশ্বাস হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত অন্বেষণ। এটি জ্ঞানের গণতন্ত্রীকরণ, প্রতিধ্বনি-কক্ষের দখল কমে, নৈতিক গভীরতা বাড়ে, যদি ঐতিহ্যিক পরিসর মানিয়ে নিতে পারে।
 
রিলসের মতো স্বল্পদৈর্ঘ্য কনটেন্ট জটিলতা বাড়ায়, ভাবনা টুকরো করে আবেগ জাগায় বা অর্ধসত্য ছড়ায়, যেমন সিডনির হামলার অনলাইন পথ। তবে এটিই আগ্রহ জাগায়, মিথ ভাঙে, পূর্ণাঙ্গ উৎসে পৌঁছে দেয়। তথ্যের বন্যায় বাছাই কঠিন, তবু নিবেদিত অনুসন্ধানীরা ধীরে ধীরে বিচারবুদ্ধি গড়ে তোলে।
 
লাল কেল্লার কাছে দিল্লি বিস্ফোরণের স্থান
 
দীর্ঘদিন তরুণ মুসলিমদের অনলাইন উপস্থিতি মানেই ঝুঁকি, গোপন ফোরামে নিয়োগ, দুর্বলদের টার্গেট; এই গল্পই প্রাধান্য পেয়েছে। ঝুঁকি আছে। কিন্তু উল্টো দিকটি উপেক্ষিত: ‘ডিজিটাল শিষ্যত্ব’ বা তারবিয়াহ; জ্ঞানভিত্তিক কমিউনিটিতে চরিত্রগঠন। প্ল্যাটফর্ম মসজিদের বিকল্প নয়; প্রবেশদ্বার। একটি ছোট ভিডিও প্রশ্ন তোলে, প্রশ্ন নিয়ে যায় গভীর পাঠে। আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ার ২৬ জুলাই ২০২৫-এর গবেষণায় ৩৪৫ জন জেন জি শিক্ষার্থীর ৭৮ শতাংশ জানিয়েছে, তারা বিশ্বাস-উন্নতির জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ফিড সাজায়; কুরআন তিলাওয়াতের সঙ্গে অ্যাম্বিয়েন্ট ট্র্যাক, ধৈর্যকে মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে জোড়া পোস্ট। ‘রিলিজিয়নস’ জার্নালের জানুয়ারি ২০২৫-এর গুণগত গবেষণায় মুম্বইয়ের ৬৪ জন জেন ওয়াই ও জেন জি; খ্রিস্টান, হিন্দু ও মুসলিম দেখিয়েছে, ইন্টার‌্যাকটিভ রিলস আবেগের মাধ্যমে বিশ্বাসকে প্রভাবিত করে, প্রায়শই সম্পর্ককে গভীর করে। এভাবেই বিষাক্ততার জবাবে আসে চিন্তাশীল সম্পৃক্ততা।
 
শতাব্দী আগে মদিনায় আশহাব-উস-সুফ্ফা নবীর মসজিদের পাশে সাদামাটা জীবন যাপন করে কুরআন ও হাদিসে মনোনিবেশ করেছিলেন। সেখান থেকেই শিক্ষাস্থানের নকশা, রিবাত, সুফি জাওয়িয়া, মধ্যযুগীয় মাদ্রাস, বিশ্বাস ও যুক্তির মেলবন্ধন। আজ সেই নিবেদন অনলাইনে বেঁচে আছে।
 
তরুণেরা নিছক স্ক্রল করছে না; তারা গড়ছে ডিজিটাল রুটিন; মধ্যরাতে অর্থের খোঁজ, আচারকে বাস্তব জীবনের টিপসের সঙ্গে জোড়া রিল, মনোবিজ্ঞানে ব্যাখ্যাত ধৈর্য। এটি উপরিতল নয়; স্ফুলিঙ্গ থেকে জন্মায় স্থায়ী অধ্যয়ন। যেমন সুফ্ফার সঙ্গীরা বাণিজ্যের প্রলোভন এড়িয়েছিলেন, তেমনি আধুনিক অনুসন্ধানীরা অন্তহীন ফিডের বিভ্রান্তি পাশ কাটায়। রূপ বদলায়; বেঞ্চ থেকে স্ক্রিন, দল থেকে গ্রিড, কিন্তু অর্থবহ জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা অটুট, আত্মাকে গড়ে তোলে।
 
পাহালগাম, দিল্লি, সিডনি, এগুলোকে আলাদা ব্যর্থতা হিসেবে দেখানো হয়। আসলে একসঙ্গে তারা উগ্রপন্থার বিস্তার উন্মোচন করে, স্থান, মানুষ বা পথে সীমাবদ্ধ নয়। বিচ্ছিন্নতা থেকে জন্ম নিয়ে প্রযুক্তিতে বেগ পায়, সমাধানও হতে হবে বিস্তৃত: মাদ্রাসার পুনরুজ্জীবন, মিডিয়া-বোধ, আন্তঃধর্ম সংলাপ। সুফ্ফার পাঠ আজও প্রাসঙ্গিক, সত্যের আন্তরিক অনুসন্ধানই আমাদের সেরা ঢাল। জীর্ণ চাটাই হোক বা আলোকিত পর্দা; এই অনুসন্ধানই অন্ধকার দূরে রাখে।