আমির সুহেল ওয়ানি
কাশ্মীরে বছরকে শুধু সময়ের একক হিসেবে দেখা যায় না; এখানে প্রতিটি বছর হয়ে ওঠে এক একটি অনুভব, যা বয়ে আনে যন্ত্রণা, সহনশীলতা আর স্মৃতির ভার। এই উপত্যকায় সময় কখনো সরলরেখায় এগোয় না; সে ঝিলামের স্রোতের মতো, কখনো উত্তাল, কখনো শান্ত, কিন্তু সর্বদা অতীতের ছাপ বহন করে। তাই ২০২৫ সাল কাশ্মীরিদের স্মৃতিতে কোনো আলোড়ন তোলা ভাষণ বা উচ্চকণ্ঠ স্লোগানের বছর হয়ে থাকবে না। বরং এটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে সেই বিরল সময় হিসেবে, যখন পাহালগামের সন্ত্রাসী হামলা ও তার পরবর্তী ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর ছায়া সত্ত্বেও জীবনে ধীরে ধীরে ফিরে এসেছিল নিশ্চিন্ত নিঃশ্বাস, নীরবে, কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ে।
এসব ঘটনার পরও উপত্যকায় একটি বিষয় বদলায়নি, শান্তির পরিবেশ। শান্তি কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নিয়ে আসেনি, কোনো উৎসবের ডাকে হাজির হয়নি। সে এসেছে নিঃশব্দে, খানিক দ্বিধায়, যেমন তুষার গলে মাটির বুকে মিশে যায়, যেমন করেই বাদাম ফুল ফোটে কোনো করতালি ছাড়াই। শান্তি ধরা দিয়েছে সেই সব সাধারণ মুহূর্তে, যেগুলো একসময় অকল্পনীয় ছিল, শিশুরা আর ভয়ভীত চোখে নয়, নিশ্চিন্তে স্কুলে যাচ্ছে; দোকানদাররা রাতে ভয় ছাড়াই শাটার নামাচ্ছে; পরিবারগুলো মাসের পর মাস আগে বিয়ের পরিকল্পনা করছে এই সহজ বিশ্বাসে যে আগামী দিন ঠিক সময়েই আসবে। এই মুহূর্তগুলো তুচ্ছ নয়; এরা রাজনীতির চেয়েও গভীর অর্থ বহন করে, কারণ এখানে রাজনীতি মানে মানুষের যাপিত জীবন। দীর্ঘদিন অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে থাকা এক অঞ্চলে আবার সময়কে বিশ্বাস করতে পারা ছিল এক নীরব বিপ্লব।
শীতকালীন ছুটির পর স্কুল খোলার প্রথম দিনে স্কুলের শিশুরা
২০২৫ সালে স্বাভাবিকতাই হয়ে উঠেছিল অসাধারণ। গণপরিবহণ আবার সময় মেনে চলতে শুরু করল। বাজার সন্ধ্যার পরও মুখর থাকল। কথোপকথন ফিরে এল বাস্তব আর ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে, আবহাওয়া, পরীক্ষার ফল, ব্যবসার ভবিষ্যৎ, চিকিৎসার প্রয়োজন, যে বিষয়গুলো একসময় আতঙ্ক আর জরুরি পরিকল্পনার কোলাহলে হারিয়ে গিয়েছিল। জীবন আর স্থগিত বা অস্থায়ী মনে হচ্ছিল না; তা হয়ে উঠেছিল ধারাবাহিক। শহর থেকে গ্রাম, সর্বত্র মানুষ লক্ষ করল, নীরবতার অর্থ বদলে গেছে। সে আর ভয়ের ভার বহন করে না। সে শান্ত, সে অর্জিত।
উন্নয়ন, যা এতদিন কাগজে-কলমে আলোচিত ছিল, ২০২৫ সালে বাস্তব হয়ে উঠল। বড় ঘোষণায় নয়, বরং দৈনন্দিন চলাচলে তার উপস্থিতি টের পাওয়া গেল। দিল্লি-কাশ্মীর রেলসংযোগ ছিল শতাব্দীর উন্নয়ন। এই সংযোগ কেবল যাতায়াত সহজ করেনি, ভেঙে দিয়েছে দীর্ঘদিনের আবেগী বিচ্ছিন্নতাও। বাড়তি সড়ক যোগাযোগ শুধু জায়গাকে নয়, মানুষ আর সম্ভাবনাকেও যুক্ত করেছে।
ডিজিটাল সংযোগ সেই বিচ্ছিন্নতাকে কমিয়ে দিল, যা এতদিন গ্রামীণ জীবন আর তরুণ স্বপ্নকে আটকে রেখেছিল। দূরবর্তী কোনো গ্রামের ছাত্র নির্বিঘ্নে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারল; এক তরুণ উদ্যোক্তা মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই কাশ্মীরি হস্তশিল্প বিক্রি করতে পারল উপত্যকার বাইরে। উন্নয়ন, যখন সত্যিই কাজ করে, তখন সে প্রশংসা দাবি করে না, সে নিঃশব্দে রুটিনের অংশ হয়ে যায়।
জাতীয় পতাকা হাতে পদযাত্রায় ওমর আবদুল্লাহ ও লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা
স্বাস্থ্যব্যবস্থাও মানুষের কাছাকাছি এলো। উন্নত হাসপাতাল, ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ইউনিট আর টেলিমেডিসিন বহু পরিবারের সেই দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রা কমিয়ে দিল, যা একসময় সাধারণ চিকিৎসার জন্যও করতে হতো। অনেকের কাছে অগ্রগতি মানে ছিল নীতিপত্র নয়, বরং স্বস্তি, সময় বাঁচা, দুশ্চিন্তা কমা, মর্যাদা রক্ষা।
২০২৫ সালের সবচেয়ে গভীর পরিবর্তনটি ঘটল কাশ্মীরের তরুণদের মনে, নীরবে, অথচ গভীরভাবে। বহু বছর ধরে তারা অনিশ্চয়তার ভাষায় বড় হয়েছে, ব্যাখ্যা ছাড়াই সংঘাতের উত্তরাধিকার পেয়েছে, সম্মতি ছাড়াই উদ্বেগ বহন করেছে।
২০২৫ সালে তারা শিখতে শুরু করল আরেক ভাষা, সম্ভাবনার ভাষা। দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র, স্টার্টআপ, ক্রীড়া একাডেমি, পড়াশোনার কোচিং হাব, এসব হয়ে উঠল দিকনির্দেশের জায়গা, হতাশার নয়। ফুটবল মাঠ আবার হাসি আর প্রতিযোগিতার শব্দে ভরে উঠল। গ্রন্থাগারগুলোতে প্রাণ ফিরল। হতাশার জায়গায় ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে স্থান নিল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ভবিষ্যৎ আর দূরের কোনো বিমূর্ত ধারণা রইল না, তা হয়ে উঠল প্রস্তুতির বিষয়।
শীতের মরশুমে কাশ্মীরের ডাল লেকের একটি ছবি
পর্যটনও ফিরে এলো এক ভারসাম্যপূর্ণ ছন্দে। তা আর আগ্রাসন নয়, বরং সংলাপ হয়ে উঠল। পর্যটকরা কেবল সৌন্দর্য দেখতে নয়, শোনার জন্যও এলো। হোমস্টে বাড়তে লাগল, জীবিকা তৈরি করল, মর্যাদা বজায় রাখল। স্থানীয় গাইডরা আবার ইতিহাস, সংস্কৃতি আর স্থিতিস্থাপকতার কথক হয়ে উঠল, দর্শনীয় বস্তু হিসেবে নয়, জীবিত সত্য হিসেবে। ২০২৫ সালের পর্যটন ছিল কম ভোগবাদী, বেশি অংশগ্রহণমূলক, সম্মানের ভিত্তিতে গড়া এক আদান-প্রদান।
কাশ্মীরে শান্তি সবসময়ই নাজুক, শতাব্দীর ইতিহাস আর সাম্প্রতিক ক্ষতের দ্বারা গঠিত। ২০২৫ সালে এই শান্তি টিকে ছিল প্রদর্শনের মাধ্যমে নয়, বরং সম্মিলিত সংযমের মাধ্যমে। নাগরিক সমাজের উদ্যোগ, নারী সংগঠন, যুব ফোরাম, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলো নীরবে মাটির কাছ থেকে আস্থা পুনর্গঠন করেছে।
নিরাপত্তা ছিল কার্যকর, কিন্তু কম দৃশ্যমান। তার সাফল্য ছিল উপস্থিতিতে নয়, অনুপস্থিতিতে, বিঘ্নের অনুপস্থিতিতে, দৈনন্দিন জীবনের নির্বিঘ্ন প্রবাহে। স্থিতিশীলতা এনে দিল এক বিরল বিলাস, পরিকল্পনা করার ক্ষমতা, তাৎক্ষণিকতার বাইরে ভবিষ্যৎ কল্পনা করার সুযোগ।
চিল-এ-কালান শুরু হওয়ায় স্কুলের বাচ্চারা গুলমার্গে পিকনিকে যাওয়ার এক দৃশ্য
২০২৫ সালে কাশ্মীর তার ক্ষত ভুলে যায়নি। সে আরও কঠিন কিছু করেছে, সে ক্ষতের ভেতর বাস করা বন্ধ করেছে। কৃষকরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাগান লাগিয়েছে, জেনে যে ফসল তুলবে। অভিভাবকরা কন্যাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছে, বিশ্বাস করেছে যে দরজা খুলবে। ছোট ব্যবসা বেড়েছে, শিল্পীরা সৃষ্টি করেছে, ছাত্ররা স্বপ্ন দেখেছে। কাশ্মীরের আশা কখনোই সরল ছিল না, তা সতর্ক, অভিজ্ঞ আর দৃঢ়। ২০২৫ সালে সেই আশা ফিরে এসেছে বিভ্রম হিসেবে নয়, অভিপ্রায় হিসেবে।
ইতিহাস হয়তো ২০২৫ সালকে নাটকীয় বলে লিখবে না। কিন্তু কাশ্মীরিরা মনে রাখবে এই বছরটিকে সেই সময় হিসেবে, যখন জীবন হালকা লাগতে শুরু করল, যখন নীরবতা মানে ভয় নয়, শান্তি, যখন টিকে থাকা ধীরে ধীরে রূপ নিল বাঁচার মধ্যে। কাশ্মীরে একটি পুরনো প্রবাদ আছে, দীর্ঘ শীতের পর নবজাগরণ শুধু সম্ভবই নয়, অনিবার্য।
আর প্রতি বসন্তে যেমন বাদাম ফুল ফিরে আসে, তেমনি ২০২৫ সালে কাশ্মীর নিজেকে, এবং বিশ্বকে আবার মনে করিয়ে দিল, সে এখনও জানে কীভাবে ফুঁটে উঠতে হয়।