পল্লব ভট্টাচার্য
দক্ষিণ এশিয়ার ভূগোল বরাবরই ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে পারস্পরিক নির্ভরতার এক সূক্ষ্ম সমীকরণে বেঁধে রেখেছে। কিন্তু ঢাকায় সাম্প্রতিক কালে উঠে আসা কিছু তীব্র রাজনৈতিক বক্তব্য সেই সমীকরণের স্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। সদ্য গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির প্রভাবশালী নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, ‘সেভেন সিস্টার্স’-কে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি দেন। তিনি স্পষ্টভাবে শিলিগুড়ি করিডর বা বহুল পরিচিত ‘চিকেনস নেক’ কেটে দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
এটি নিছক উত্তেজক ভাষণ ছিল না; বরং এক সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক বার্তা। তাঁর অভিযোগ ছিল, ভারত বাংলাদেশে ‘অরাজকতা সৃষ্টিকারী’ শক্তিকে সমর্থন করছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা করছে, ডানপন্থী কর্মী ওসমান হাদির ওপর হামলায় জড়িতদের আড়াল দিচ্ছে (যার জেরে তিনি গুরুতর আহত হন), সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার সঙ্গে যুক্ত এবং এমন শক্তিকে আশ্রয় দিচ্ছে যারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, ভোটাধিকার ও মানবাধিকারকে মর্যাদা দেয় না। এই বক্তব্যের মাধ্যমে ভারতকে ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ থেকে ‘শত্রুভাবাপন্ন আধিপত্যবাদী’ হিসেবে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
একই সঙ্গে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যৌথ আত্মত্যাগকে খাটো করা এবং ভারতের বিরুদ্ধে নির্বাচন নস্যাৎ করার অভিযোগ এক গভীর রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক রূপান্তরের ইঙ্গিত দেয়, যা ভারতের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষিতে নয়াদিল্লি বাংলাদেশ হাইকমিশনার মুহাম্মদ রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানিয়েছে।
বাংলাদেশে এই বাড়তে থাকা ভারত-বিরোধী মনোভাব আসলে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পুনর্গঠনের প্রতিফলন। নতুন করে উঠে আসা ছাত্রনেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মগুলোর কাছে ভারত-বিরোধিতা একটি সহজ ও আবেগপ্রবণ হাতিয়ার, যার মাধ্যমে জটিল শাসননীতি বা বাস্তব কর্মসূচি ছাড়াই ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষা’র ভাবমূর্তি তৈরি করা যায়। ভারতকে বিতর্কিত বা অজনপ্রিয় রাজনৈতিক শক্তির গোপন পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তুলে ধরে তারা একদিকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল করতে চায়, অন্যদিকে ভারতের আঞ্চলিক ভূমিকার বৈধতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলতে চায়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে জলবণ্টন, বাণিজ্য ঘাটতি এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ ঘিরে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ। পাশাপাশি, কিছু বহিরাগত শক্তিও এই বক্তব্যকে উসকে দিয়ে বাংলাদেশকে ভারতের কৌশলগত বলয় থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিকল্প জোট ও বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করতে চাইছে।
প্রতীকী ছবি
এই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত পরিমিত, কৌশলগত এবং সংযত, আবেগপ্রবণ বা তড়িঘড়ি প্রতিক্রিয়া নয়। শিলিগুড়ি করিডর নিয়ে দেওয়া হুমকি মূলত মানসিক চাপ তৈরির কৌশল, যা কট্টর সমর্থকদের উদ্দেশে ছোড়া বার্তা। তবে এটি ভারতের একটি বাস্তব ভৌগোলিক দুর্বলতার কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়, যাকে নীরবে আরও মজবুত করা দরকার। তবু এই ধরনের বক্তব্যকে রাষ্ট্রের নীতির প্রতিফলন হিসেবে ধরে নিলে প্ররোচনাকারীরাই রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেয়ে যাবে। তাই প্রকাশ্যে সংযত নীরবতা বজায় রেখে কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে স্পষ্ট ও দৃঢ় বার্তা পৌঁছে দেওয়াই শ্রেয়, যে কোনওভাবেই ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি হুমকি বরদাস্ত করা হবে না। প্রকাশ্য বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ‘দাপুটে প্রতিবেশী’ হিসেবে ভারতকে চিত্রিত করতে চাওয়া শক্তির হাতই শক্ত হবে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা কেবল সামরিক প্রস্তুতির ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কাঠামোগত পারস্পরিক নির্ভরতাকে গভীর করার মধ্যেই তার প্রকৃত সুরক্ষা নিহিত। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট, রেলপথ ও নৌপথ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন হলে এমন বাস্তবতা তৈরি হবে, যেখানে সম্পর্ক বিঘ্নিত হলে উভয় দেশকেই বড় মূল্য দিতে হবে।
যত বেশি বাংলাদেশি কর্মসংস্থান, রপ্তানি ও শিল্প সম্ভাবনা ভারতীয় বাণিজ্য ও জ্বালানি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হবে, ততই চরম ভারত-বিরোধী রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা কমবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন অভিজাত-কেন্দ্রিক কূটনীতি থেকে সরে এসে মানুষ-কেন্দ্রিক উদ্যোগ, যেমন শিক্ষাবৃত্তি, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং ডিজিটাল যোগাযোগ বাড়ানো, যাতে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ ভারতকে শোষক নয়, উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে দেখতে শেখে।
সবশেষে, বাংলাদেশে সকল গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে নির্দলীয় ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলাই ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে জরুরি। একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতের ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে অমীমাংসিত জলবণ্টন চুক্তি সম্পন্ন করা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দৃশ্যমান, পারস্পরিক লাভজনক প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে ভারতের বিরুদ্ধে ‘শোষণের’ বয়ান দুর্বল হবে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
বর্তমান টানাপোড়েনকে সংকট হিসেবে না দেখে সতর্কবার্তা হিসেবে গ্রহণ করা উচিত, যাতে সম্পর্ককে রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে তুলে এনে আঞ্চলিক সমৃদ্ধির বৃহত্তর কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করা যায়। নীতিগত প্রশ্নে দৃঢ়তা, উসকানির জবাবে সংযম এবং দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বে কৌশলী বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারত নিশ্চিত করতে পারে, অস্থায়ী স্লোগান ও উত্তেজক বক্তব্য যেন এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বিপথে না নিয়ে যায়।
(লেখক: অসম সরকারের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ মহাপরিচালক; প্রাক্তন অসম লোকসেবা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং ‘আওয়াজ – দ্যা ভয়েস অসম’-এর মুখ্য কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা)