দেবকিশোর চক্রবর্তী
নৌসেনা সপ্তাহ উপলক্ষে খিদিরপুর বন্দরে নোঙর করল অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ আইএনএস রণ তরী। শনিবার ভোর থেকেই বন্দর এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে শুরু হয়েছিল তীব্র কৌতূহল, কোন বিশেষ কারণ ছাড়াই কি যুদ্ধজাহাজ এসে দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। অনেকেই প্রথমে ভেবেছিলেন কোনও নিরাপত্তা সতর্কতা কিংবা সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবেই হঠাৎ আগমন। পরে জানা যায়, এটি নৌসেনা সপ্তাহের আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী কর্মসূচির অংশ হিসেবেই কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে নোঙর করা হয়েছে।
সকালের কুয়াশা কাটতেই নদীর মাঝখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় ধূসর রঙের লম্বা মসৃণ দেহ, উপরে রাডার, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আধুনিক অস্ত্রসজ্জা। যুদ্ধজাহাজটি যখন ধীরে ধীরে বন্দরের ঘাটের কাছাকাছি ভিড়ছিল, তখন দাঁড়িয়ে থাকা দর্শনার্থীদের ভিড় আরও ঘন হতে থাকে। অনেকে মোবাইলে ছবি তুলতে থাকেন, কেউ কেউ আবার জাহাজটির নাম উচ্চারণ করে আশপাশের লোকজনকে জানাতে থাকেন যে এটি দেশের অন্যতম উন্নত নৌযান।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে জানান, এই ধরনের বিশাল যুদ্ধজাহাজ খুব কমই এই বন্দরে আসে। ফলে সকাল থেকেই স্থানীয় চায়ের দোকান, ফেরিঘাট ও বাজারে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল জাহাজটি। অনেকে উদ্বেগের সুরে বলছিলেন, “কোনও ঝুঁকির খবর আছে কি?” আবার অন্যদিকে অনেকের ভাষ্য, “আমাদের বাংলাতেই যখন তৈরি হয়েছে, কাছ থেকে না দেখে কি থাকা যায়!”
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, আইএনএস রণ তরী যে দুটি যুদ্ধজাহাজের সিরিজের অংশ, সেগুলোর নির্মাণ হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের শিপইয়ার্ডে। তাই এই জাহাজ কলকাতায় আসা মানে বাংলার তৈরি জাহাজের প্রতি একরকম সম্মান প্রদর্শনও বটে। নির্মাণ সময়ে এই অঞ্চলের বহু প্রকৌশলী, কারিগর ও শ্রমিক এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নৌসেনা সপ্তাহের আয়োজন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জনসাধারণকে দেশীয় প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করাই এই সফরের মূল উদ্দেশ্য।
নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, জাহাজটি কয়েক দিনের জন্য এখানে অবস্থান করবে এবং নির্দিষ্ট সময়ে ছাত্রছাত্রী, আমন্ত্রিত অতিথি ও কিছু নির্বাচিত সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য জাহাজ পরিদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সবক্ষেত্রেই কঠোর বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা হবে। তিনি বলেন, “নৌসেনা সপ্তাহ আমাদের সামুদ্রিক নিরাপত্তা, উদ্ধার অভিযান, প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং মানবিক সেবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন করার একটি উদ্যোগ। খিদিরপুর বন্দরে যুদ্ধজাহাজ প্রদর্শন সেই উদ্যোগেরই অংশ।”
বন্দরের আশপাশের ব্যবসায়ীরাও জানান, জাহাজ আসার পর থেকেই তাঁদের দোকানে ভিড় বেড়েছে। অনেকে দূর এলাকা থেকেও এসে জাহাজ দর্শন করে যাচ্ছেন। এক ব্যবসায়ীর কথায়, “এমন সুযোগ বারবার আসে না। তাই মানুষও ভিড় করছেন। আমাদের ব্যবসাও কিছুটা বাড়ছে।”
তবে উদ্বেগ একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কিছু মানুষ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, কোনও রাজনৈতিক বা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে কি এই সফরের সম্পর্ক আছে? এই প্রশ্ন উঠতেই বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌসেনার পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, এটি সম্পূর্ণ পূর্বনির্ধারিত সাংস্কৃতিক ও সচেতনতা কর্মসূচি। কোনও নিরাপত্তাজনিত সতর্কতা এর সঙ্গে জড়িত নয়।
দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্দরের ওপারে নদীর বাতাসে দুলতে থাকা যুদ্ধজাহাজটি আরও বেশি দর্শনার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। সন্ধ্যার পর জাহাজের আলোকসজ্জা পুরো এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করে। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, সকলের চোখে মুখে রণ তরীকে এক ঝলক দেখার আনন্দ।
খিদিরপুর বন্দর প্রশাসন জানিয়েছে, নৌসেনা সপ্তাহ উপলক্ষে আগামী কয়েকদিন এলাকায় ছোটখাটো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ও সচেতনতা সভারও আয়োজন করা হবে। এর ফলে বন্দর এলাকা যেমন ব্যস্ত ও উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে, তেমনি বাংলায় নির্মিত যুদ্ধজাহাজকে সামনে রেখে গর্বের অনুভূতিও ফুটে উঠছে মানুষের কথায়।
সব মিলিয়ে, খিদিরপুর বন্দরে যুদ্ধজাহাজ আগমনের ঘটনাটি স্থানীয় মানুষের মনে যেমন চমক এবং কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে, তেমনি তৈরি করেছে উৎসবের আবহ, যেখানে দেশের প্রতিরক্ষা শক্তির অংশ হয়ে ওঠা একটি যুদ্ধজাহাজকে কাছ থেকে দেখার সুযোগই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।