শান্তি প্রিয় রায়চৌধুরী
সেই হারানো স্মৃতিগুলো আজও মনে পড়ে সেই দিনের মানুষগুলোর মনে। অতীতের সেই কলকাতাতো আর আজকের কলকাতা নয়। গ্রীষ্মের একটা দিন হতাশায় ভরা মন নিয়ে কিশোর নবীনচন্দ্র বসেছিলেন বাগবাজারে রাস্তার ধারে এক ঝুপড়ির দোকানে, সেকালে মিষ্টির পশরা সাজিয়ে। হঠাৎই তার দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল একটি ঘোড়ার গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে এক তৃষ্ণার্ত যুবক পানীয় জল চাইলেন নবীনচন্দ্রের দোকানে। তখনকার প্রথামতো জলের সঙ্গে এলো রসগোল্লা। রসগোল্লা খেয়ে মুগ্ধ কিশোর। কিশোরের প্রশংসায় দারুন অনুপ্রাণিত কিশোর নবীনচন্দ্র। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি নবীনচন্দ্র দাসকে। প্রচার পেল নবীনচন্দ্রের আবিষ্কার। কথাতেই আছে- রসে বসে বাঙালি। আর রস বলতেই যার নাম আগে আসে তা হল রসগোল্লা। আর এই রসগোল্লার আবিষ্কার কর্তা নবীনচন্দ্র দাস, যা আজ কারো অজানা নয়।
সেই ১৮৬৮ থেকে ২০২৫। ১৫৮ টা বছর মুখোমুখি। একটুকুও ম্লান হয়নি নবীনচন্দ্রের রসগোল্লার খ্যাতি। বাগবাজারের ঝুপড়ির দোকানের আধিকারিক আজ বিশ্বের দরবারে প্রশঙসিত।
'কে সি দাস' মিষ্টির দোকান
মনটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক মিষ্টির জগতের সেই ব্যতিক্রমী মানুষ ভোলা ময়রার দিকে। মিষ্টি নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর ছড়াই তিনি কাটতেন। এই ভোলা ময়রার মিষ্টির স্বাদেই মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগরও। তাঁর রচনাতে তিনি একবার লিখেছিলেন, 'ভোলার ন্যায় ময়রার প্রাদুর্ভাব হওয়া নিতান্ত প্রয়োজন।' এই ভোলা ময়রার পৌথীর সঙ্গে নবীনের বিবাহ হয়েছিল। নবীনের একমাত্র পুত্র ছিলেন কূষ্ণচন্দ দাস। কূষ্ণচন্দ দাস অর্থাৎ কেসি দাস নামেই তিনি সকলের কাছে পরিচিত। বর্তমানে তার পাএ বদ্ধ রসমালাই মিষ্টি রসিকদের তাক লাগিয়ে দিয়ে ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি দিয়েছে আমেরিকা, লন্ডন থেকে আরো অনেক দেশে। এবার ২০২৫ এসেও বাদ যায়নি। এবারও পুজোয় কেসি দাসের পাএ বন্দী রসগোল্লা বিদেশে পাড়ি দিয়েছে।
'দ্বারক গ্র্যান্ড সন্স' মিষ্টির দোকানের ছবি
মিষ্টির বাজারে আর এক অবিস্মরণীয় নাম দ্বারিকানাথ ঘোষ। কে না জানে মিষ্টান্ন জগতের দ্বারিকা নাথ ঘোষের নাম। ১৮৮৫ সালে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল ৭৭ নম্বর শ্যামপুকুর স্ট্রিট থেকে। তার মিষ্টি গুণে মানে ছিল অসাধারণ। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারিকা বাবুর মিষ্টির প্রশংসায় এতটাই পঞ্চমুখ ছিলেন যে তিনি দ্বারিকা ঘোষকে 'রসস্রষ্টা' হিসেবেও অভিহিত করেছিলেন।
বউবাজারের প্রসিদ্ধ 'ভীম চন্দ্র নাগ' মিষ্টির দোকানের ছবি
মিষ্টির জগতে আর এক অবিস্মরণীয় নাম ভীম নাগ। যে নাম সকলের মুখে মুখে। সন্দেশ মানেই ভীম নাগ ১৮২৬ সাল থেকে বউবাজারের অতি প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন দোকান। দু'শো বছর পেরিয়ে গেছে বাংলার এই প্রতিষ্ঠানটি। বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ ভীম নাগের মিষ্টির স্বাদ নিয়ে মোহিত হতেন। স্বয়ং ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণও ভীম নাগের সন্দেশ পছন্দ করতেন। রানী রাসমণি থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উত্তম কুমার, রবি ঘোষ পছন্দ করতেন ভীম নাগের সন্দেশ। এমনকি সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেবের মত ক্রীড়া ব্যক্তিত্বও কলকাতায় এলেই ঘুরে যেতেন ভীম নাগের দোকান থেকে।
সন্দেশ তৈরির জন্য বিখ্যাত 'সেন মহাশয়' মিষ্টির দোকানের একটি ছবি
সন্দেশ তৈরির আরেক উল্লেখযোগ্য দাবিদার 'সেন মহাশয়'। ১৮৯৭ সালে উত্তর কলকাতার ফড়িয়া পুকুর স্ট্রিটে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু। সেঞ্চুরি পেরিয়ে আরো পঁচিশটা বছর ছুঁয়ে ফেলেছে সেন মহাশয়। এক সময় সেন মহাশয়ের সন্দেশের স্বাদ নিতে রবীন্দ্রনাথ সেন মহাশয়ের দোকানে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নলেন গুড়ের সন্দেশ খেয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ থেকে সেন রাজারা গেছেন ঠিকই কিন্তু আরও এক সেন রাজত্ব করে চলেছেন। কথিত আছে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখনই মামার বাড়ি থাকতেন তখনই তার বাধা ছিল সেন মহাশয়ের সন্দেশ।
গিরিশচন্দ্র দে এন্ড নকুড় চন্দ্র নন্দীর মিষ্টির দোকান
সন্দেশের জন্য জগৎ বিখ্যাত হেদুয়া পার্কের রাম দুলাল স্ট্রিটের শতাব্দী প্রাচীন গিরিশচন্দ্র দে এন্ড নকুড় চন্দ্র নন্দীর মিষ্টির দোকান। ১৮৪৪ সাল থেকে তিনি বাঙালিকে খাইয়ে আসছেন শুধুই সন্দেশ। কত রকমের সন্দেশই না আছে এখানে। আর স্বাদ, না খেলে বুঝতেই পারবেন না! গরমে মনকে শান্তি দিতে থাকে নানান ধরনের আমের তৈরি সন্দেশ। রয়েছে ম্যাঙ্গো ও চকোলেট, সিঙাড়া যা আদতে সন্দেশই। এছাড়া গোলাপী পেড়া, দিলখুশ, পারিজাত এই দোকানের মিষ্টির মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
দক্ষিণ কলকাতার 'বলরাম মল্লিক এন্ড রাধারমন মল্লিক'- এর মিষ্টির দোকান
দক্ষিণ কলকাতার বলরাম মল্লিকের মিষ্টির দোকান। এখানকার নলেন গুড়ের 'সুফলে' খুবই জনপ্রিয়। এছাড়া তো মধু দিয়ে তৈরি মধু শ্রী, কমলা ভোগ ট্রাসেল, ম্যাঙ্গো সুফলে এবং কুলফি সন্দেশ,রোজ ক্রিম, দিলখুশ, এসব কিছুর অসাধারণ স্বাদ দিতে এরা সব সময়ই তৈরি। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী যে সমস্ত মিষ্টির দোকান রয়েছে কলেজ স্ট্রিটের পুটিরাম একটি অন্যতম নাম। হুগলির চন্দননগর থেকে এসে মির্জাপুর স্ট্রিটে পুটিরাম দোকান করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুটিরামের দোকানের কলেবর বৃদ্ধি পায়। অতীতের মতো আজও পুটিরামের মেঠাই, রাধাবল্লভ সমান জনপ্রিয়।
বাংলার সন্দেশ-রসগোল্লা শুধুমাত্র ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়, পাড়ি দিয়েছে বিদেশেও। গৌরব বাড়িয়েছে বাংলার, বাঙালির। আর বাঙালির গৌরব বাড়ানোর পেছনে যারা কাজ করছেন, তারা হলেন বাংলার সুদক্ষ কারিগররা। আর বাংলার এইসব সুদক্ষ কারিগরের নিরন্তন সাধনার জন্যই বাংলার মিষ্টি আজও জগৎজোড়া নাম। বলা যেতে পারে বাংলার মিষ্টি বাংলার অন্যতম প্রধান কৃষ্টি।