শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কোন কালে লিখেছিলেন, ' 'কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্খস্ গজ্গজ্ করিতে লাগিল'। তিনি সেই সময় দাঁড়িয়ে স্পট দেখতে পেয়েছিলেন বর্তমান সময়কে। ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা এই মানুষটি সেদিনই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে আমাদের তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা হলে কী ভয়ানক পরিণতি বহণ করে নিয়ে আসছে আমাদের জন্য ; থুড়ি বলা ভালো আমাদের সমাজের খুদে শিক্ষার্থীদের জন্য। সেদিন তিনি যে চাপিয়ে দেওয়া, জোর করে গলধঃকরণ করানো শিক্ষার কথা বলেছিলেন আজ আমরা সেই কথারই বাস্তবায়ন করতে উঠে পড়ে লেগেছি।
একটু বর্তমান সময়ের পাঠ্যক্রমের দিকে চোখ ফেরাতেই আমরা আসল কথাটা বুঝতে পারব। আজকালকার ছোট ছোট বাচ্চাদের উপর কতটা মানসিক চাপ! স্কুলগুলো এমনভাবে পড়াশোনার টাইমলাইন আর পরীক্ষার তারিখ ঠিক করে যেন ওদের জীবনে আনন্দের কোনো জায়গাই নেই।
আমাদের ছোট বেলায় যদি ফিরে তাকাই তবে আমরা দেখতে পাই যে সেখানে আমরা গরমের ছুটি, পুজোর ছুটি, পরীক্ষা পরবর্তী ছুটি এসব অনেক দিনের পেতাম। এছাড়া তো নানা উৎসব, অনুষ্ঠান, সরকারি, আধা সরকারি মিলিয়ে আরও কয়েকডজন ছুটি বরাদ্দ থাকত সারা বছর। আর একটা ছুটির কথা খুব মনে পড়ে। সেটা হল বর্ষার দিনে অর্ধ দিবস ছুটি । যেটার খুব পরিচিত নাম হল rainy day. এখন আর সেই ছুটিগুলো যেন শুধুই ক্যালেন্ডারে রয়ে গেছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে তো আবার এক নয়া trend শুরু হয়েছে। সেটা হল গরমের ছুটি বা পূজোর ছুটি, বা session break এর পর স্কুল খুলবে শুক্রবারে, যাতে কেউ বেশি ঘোরাঘুরি না করতে পারে। যেন আনন্দটাই একটা অপরাধ! কেন সোমবার খুললে এমন কী ক্ষতি হয়ে যাবে পড়াশোনার? কিছু কিছু স্কুলে তো আবার কড়াকড়ি নিয়ম, লম্বা ছুটির পর প্রথম দিন compulsory attendance। আবার কোনো long weekend পড়লেই, তার পরের দিনই পরীক্ষা, না হয় project নাহয় class test দিয়ে দেবে । যেন ছুটি মানেই শাস্তি! রাখি, দোল, রথ, জন্মাষ্টমী, সব উৎসব যেন কেবল বইয়ের পাতায়। বাড়িতে পুজো হলেও বাচ্চারা অংশ নিতে পারে না, কারণ তাদের পড়া, প্রজেক্ট বা টেস্ট। আবার কিছু কিছু তো এমন পার্বণও রয়েছে যেখানে ছুটিটাই বরাদ্দ থাকে না শিশুদের জন্য।
আজকাল অধিকাংশ মায়েরাই কাজ করেন। সারা বছরের অফিসের হাড়ভাঙা খাটুনি, সংসারের দায়িত্ব—সব সামলে যখন একটা লং উইকেন্ড আসে, তখন মনে হয় একটু হাত-পা ছড়িয়ে বসি। কিন্তু না, তখনই মনে পড়ে—বাচ্চার weekly test, halfyearly, annual না হয় কোনো project জমা দিতে হবে। তখন আরাম বা আনন্দ মাথায় ওঠে।
প্রশ্ন হল, স্কুলগুলো এমনটা করে কী পায়? Saddistic pleasure... মনে হয়। শিক্ষক শিক্ষিকাদের কষ্ট হয়, অভিভাবকদের কষ্ট হয়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর। ওরা তো আমাদের মতো করে কিছুই উপভোগ করতে পারল না।
এত চাপ আমরা বড়রাই যখন নিতে পারছি না, তাহলে আমরা বাচ্চাদের কীভাবে সামলাব?
আমরা কি একটু থামতে পারি না?
একটু ভাবতে পারি না, কীভাবে পড়াশোনার পাশাপাশি ওদের শৈশবটাও রক্ষা করা যায়? কিচ্চু কাজের কাজ হচ্ছে না , শুধু বই পড়ে স্কুলে গিয়ে কতগুলো যন্ত্র মানব তৈরি হচ্ছে।
কী হবে এদের ভবিষ্যৎ? শৈশবই যদি এত চাপ, চিন্তা, প্রতিযোগিতায় ঠাসা হয় তবে ভবিষ্যৎ কতটা যান্ত্রিক হবে আমরা একবারও ভেবে দেখেছি কি? এবার কি একটু থামা যায় না? ভেবে দেখার সময় এসেছে এবার।