মুন্নী বেগম , গুয়াহাটি
‘থাকা’ এবং ‘খাওয়া’—এই দুটি মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন। এরজন্য বহু মানুষকে বিভিন্ন সময়ে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। কারণ অনেক সময় হাতে টাকা থাকলেও ভালো থাকার জায়গা বা ভালো খাবার পেতে বহুজনকে হিমশিম খেতে হয়।কিন্তু এখন এই নিয়ে ভাবনার কিছু নেই, কারণ মাত্র ২৯৯ টাকার বিনিময়ে উন্নতমানের থাকা ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাওয়া সম্ভব ব্যয়বহুল গুয়াহাটি মহানগরে। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন। মাত্র ২৯৯ টাকায় গুয়াহাটি মহানগরের ছয় মাইলে এই বিশেষ ব্যবস্থা চালু করেছেন এক উদ্যোগী যুবক, বাবুল আলী হাজরিকা, তিনি গোলাঘাট জেলার বাসিন্দা।
বাবুল আলী হাজরিকার লজ
‘আওয়াজ - দ্য ভয়েস অসম’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাবুল আলী হাজরিকা জানান, "আমি ও আমার স্ত্রী মিলেই গুয়াহাটির ছয় মাইল উড়ান সেতুর কাছে মায়া পথে ‘হাজরিকা লজ’ নামে একটি লজ শুরু করেছি। আমাদের এই লজে আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবাররা বিশেষ সুবিধা পাবেন। আমি এই লজ চালু করার পরিকল্পনা করেছি কারণ যখন আগের দিনগুলোতে কোনও কাজে মহানগরে আসতাম, তখন থাকার ও খাওয়ার অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ, তাই সবসময় হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকত না, এবং টাকা থাকলেও ভালো থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা খুঁজে পেতে কষ্ট হতো। সেই সময় থেকেই ভেবেছিলাম, এমন একটা জায়গা করব, যেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও আরামে থাকতে ও খেতে পারবেন। তাদের সব সুবিধা স্বল্প মূল্যে দিতে পারি—এইটাই ছিল লক্ষ্য।”
গুয়াহাটিতে সাধারণত থাকা-খাওয়ার খরচ অত্যন্ত বেশি। এখানে প্রতিটি ধাপে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি টাকা খরচ হয়, তবুও মানসম্মত পরিষেবা পাওয়া যায় না। এই অবস্থায় অসমীয়া মুসলিম যুবক বাবুল আলী হাজরিকার এই উদ্যোগ অনেকের জন্য আশার আলো বলে বিবেচিত হয়েছে।
লজের ভেতরে কাজে বাবুল
হাজরিকা বলেন, “আমরা আমাদের লজ ১২ই ফেব্রুয়ারি থেকে জনসাধারণের জন্য খুলে দিয়েছি। খুব আনন্দের বিষয় যে, উদ্বোধনের দিন থেকেই লজের ২১টি কক্ষ পুরোপুরি বুকড হয়ে গেছে। যারা আমাদের এই পরিষেবা নিয়ে গেছেন, তারা খুব প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন যে গুয়াহাটির মতো একটি ব্যস্ত মহানগরেও যে ঘরোয়া পরিবেশ উপভোগ করা যায়, তা এখানে এসেই বুঝতে পেরেছি। তারা আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা আমাদের জন্য একটি বড় সাফল্য।”
সম্পূর্ণ এক ঘরোয়া পরিবেশে ঘেরা হাজরিকা লজে উজান ও নিন্ম আসামের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষের ভিড় লক্ষণীয় ।হাজরিকা লজে কেউ চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণে, আবার কেউ শিক্ষামূলক কারণে আসছেন। প্রতিটি অতিথিই এখানে এসে আরামদায়ক অভিজ্ঞতা লাভ করছেন। কারণ, এই লজটি মহানগরে্র ছয়মাইল এলাকায় অবস্থিত এবং জিএনআরসি চিকিৎসালয়, রহমান হাসপাতাল, জিএমসিএইচ, শ্রীমন্ত শঙ্করদেব কলাক্ষেত্র, শিল্পগ্রাম, খানাপাড়া পশু চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের খেলার মাঠের একেবারে কাছেই রয়েছে।
বাবুল আলি হাজরিকার লজ
হাজরিকা বলেন, “আমাদের এখানে ২৯৯ টাকা থেকে শুরু করে ৬০০০ টাকা পর্যন্ত রুম পাওয়া যায়। একজন ব্যক্তির জন্য রুম ভাড়া ২৯৯ টাকা, দুইজনের জন্য ৪৯৯ টাকা, আর সম্পূর্ণ পরিবার নিয়ে এসে রান্না-বান্না করে খাওয়ার সুবিধাসহ ৯৯৯ থেকে ১৪৯৯ টাকার মধ্যে সুবিধা পাওয়া যায়। আমাদের এখানে আসা প্রতিটি মানুষই ঘরোয়া পরিবেশ উপভোগ করতে পারেন। তাছাড়া,লজের সামনেই যথেষ্ট জায়গা রয়েছে, যেখানে অতিথিরা তাদের দুই বা চার চাকার গাড়ি পার্ক করতে পারেন। এছাড়াও শিশুরাও খেলাধুলা করতে পারে। আমি মনে করি এই লজ শুধু আমার পরিবারের জন্য নয়, এটি আমি গোটা অসমবাসীর জন্য উৎসর্গ করেছি, যাতে তারা এখানে এসে মতামত ও পরামর্শ দিয়ে লজটিকে আরও এগিয়ে নিতে সাহায্য করেন।”
বর্তমানে চারদিকে মাশরুমের মতো গজিয়ে ওঠা লজ বা হোটেলগুলির দেওয়া পরিষেবার তুলনায় হাজরিকা লজ কিছুটা ব্যতিক্রম। কারণ এখানে আসা প্রতিটি অতিথিকে উন্নতমানের থাকা ও খাওয়ার সুবিধা দেওয়া ছাড়াও, রুম বুক করার আগে আতিথেয়তার অংশ হিসেবে বিনামূল্যে জল ও চা পরিবেশন করা হয়।হাজরিকা বলেন, “অতিথি হলেন ঈশ্বরের রূপ। তাই আমরা আমাদের লজে আগত প্রতিটি অতিথিকে প্রথমেই বিনামূল্যে জল ও চা পরিবেশন করি। পাশাপাশি, কেউ যদি ১৫ দিনের বেশি সময় আমাদের এখানে থাকেন, তাহলে তার আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে তাকে ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। আবার যদি কেউ জরুরি কোনো কাজে হোটেল ছাড়তে দেরি করেন, তাহলে ১-২ ঘণ্টা পর্যন্ত অতিরিক্ত সময়ও দেওয়া হয়।”
“সততা, নিষ্ঠা ও বিশ্বাস থাকলে মানুষ সমস্ত চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারে” এই বক্তব্য রাখা হাজরিকা রমজানে তার লজে বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছেন।হাজরিকা বলেন, "রমজান মাসে আমরা লজের পক্ষ থেকে ইফতারের পাশাপাশি প্রতিদিন রাতে রোজকারের অতিথিদের জন্য বিনামূল্যে সেহরির ব্যবস্থা করি, যাতে এই পবিত্র মাসে তারা কোনো ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন না হন।"
শরাইঘাট যুদ্ধে মোগলদের পরাজিত করে বিজয় অর্জনকারী বীর লাচিত বরফুকন ও বাঘ হাজরিকার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করে যাওয়ার কথা জানান হাজরিকা। তিনি আর্থিকভাবে দুর্বল, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মানুষদের যতটা সম্ভব সাহায্য করার এক গভীর ইচ্ছা বুকে ধারণ করে এই ব্যবসার মাধ্যমে নিজে যেমন স্বনির্ভর হয়েছেন, তেমনি অনেকের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
তিনি বলেন, “বর্তমানে আমাদের লজে আসতে আগ্রহী অতিথিরা ৯৩৯৫২-০৮১৮৪ ও ৯৬১৩৭-৩৩৫৭৪ নম্বরে আগাম ফোন করে রুম বুক করতে পারেন। আমি আশা করি আমার এই উদ্যোগ যুবসমাজের মধ্যে এক জাগরণ সৃষ্টি করবে । আমার মতো উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতীরা শুধু সরকারি চাকরির আশায় বসে না থেকে নিজস্ব উদ্যোগে স্বনির্ভর হবে । অন্যদেরও সাহায্য করতে পারবে। আমি নিজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি এবং আমার স্ত্রী বিএ ও এলএলবি পাশ করেছে। কিন্তু অন্যের প্রতিষ্ঠানে সাধারণ বেতনে চাকরি করার বদলে আমরা নিজেরাই একটি ব্যবসা শুরু করেছি এবং এখন অন্যদেরও চাকরির সুযোগ দিতে পেরেছি। বর্তমানে আমার লজে মোট ১২ জন কর্মচারী নিযুক্ত আছেন।”