এস আই আর আতঙ্কে আত্মঘাতী যুবক, আতঙ্কের জেরে রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছে ধারাবাহিক আত্মহনন

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 14 d ago
প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি
প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি
 
দেবকিশোর চক্রবর্তী

উলুবেড়িয়ায় একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সমাজে ফের এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। এস আই আর আতঙ্কে আত্মঘাতী হলেন মাত্র আটাশ বছরের এক যুবক। মৃতের নাম সৌরভ মুখার্জি (পরিবর্তিত নাম), পেশায় একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী। তিনি উলুবেড়িয়া মহকুমার শ্যামপুর থানা এলাকার বাসিন্দা। সোমবার গভীর রাতে নিজের ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। মঙ্গলবার সকালে পরিবারের সদস্যরা ঘরের দরজা না খুললে সন্দেহ হয়। পরে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখা যায় সৌরভ ঝুলন্ত অবস্থায় আছেন। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে পাঠায়।

পরিবারের সদস্যদের দাবি, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সৌরভ ভীষণ উদ্বিগ্ন ও মানসিকভাবে অস্থির ছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “আমার নামে এস আই আর হয়েছে, সবাই আমাকে নজরে রাখছে।” জানা গেছে, কিছুদিন আগে তিনি একটি সামাজিক মাধ্যমে সরকারি নীতি নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। এরপর থেকেই সহকর্মীদের মধ্যে নানা আলোচনা শুরু হয়। সেই ঘটনার পর থেকেই সৌরভের মধ্যে প্রবল ভয় কাজ করতে থাকে। পরিবার সূত্রে জানা যায়, তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে তাঁর সমস্ত অনলাইন কার্যকলাপ, কথাবার্তা ও চলাফেরা নজরদারির আওতায় চলে এসেছে। ক্রমে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি।

বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীরা জানান, সৌরভ প্রায়ই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ‘এস আই আর রিপোর্ট কীভাবে দেখা যায়’ বা ‘নিজের বিরুদ্ধে রিপোর্ট আছে কি না’—এই ধরনের তথ্য খুঁজতেন। তাঁর মোবাইল ও ল্যাপটপ থেকেও পুলিশ এমন সার্চ হিস্ট্রি উদ্ধার করেছে বলে জানা গেছে। প্রাথমিক তদন্তে মনে করা হচ্ছে, কোনো ভুয়ো বার্তা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য তাঁর মানসিক ভারসাম্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সম্ভবত কেউ মজা করেই তাঁকে এমন ভয় দেখিয়েছিল, যা পরে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে।

ঘটনার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়তেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সমাজমাধ্যমে নানা জল্পনা শুরু হলেও প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। রাজ্যের তৃণমূল নেতৃত্ব এই ঘটনার প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তাঁর বিশেষ প্রতিনিধি মঙ্গলবার দুপুরে উলুবেড়িয়ায় পৌঁছান। তিনি মৃতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানান এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নিয়ে কোনো গুজব ছড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সৌরভের মৃত্যু আধুনিক সমাজে তথ্য-আতঙ্কের এক স্পষ্ট প্রতিফলন। বিভ্রান্তিকর বার্তা, ভুল তথ্য এবং অনলাইন গুজব মানুষের মানসিক স্থিতি নষ্ট করছে—এটি তারই নির্মম উদাহরণ। বিশেষজ্ঞদের মত, এই ধরনের গুজব রুখতে এবং মানুষকে তথ্য যাচাইয়ে সচেতন করতে প্রশাসন ও সমাজ উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে।

এদিকে শুধু উলুবেড়িয়ায় নয়, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও অনুরূপ আতঙ্কে আত্মহত্যার খবর মিলছে। গত সপ্তাহে নদিয়া, মালদা ও উত্তর ২৪ পরগনা থেকেও তিনটি আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের নজরে এসেছে, যেখানে একই রকম “এস আই আর ভয়” কাজ করেছে বলে অভিযোগ। ফলে প্রশাসন এখন গোটা রাজ্যে নজরদারি ও সচেতনতামূলক প্রচার জোরদার করার পরিকল্পনা নিচ্ছে।

উলুবেড়িয়ার এই যুবকের অকাল মৃত্যু সমাজকে আবারও মনে করিয়ে দিল—ভুয়ো খবর, অবিশ্বাস ও ডিজিটাল আতঙ্ক কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। এক তরুণ প্রাণের নিঃশেষিত হওয়া এখন রাজ্য জুড়ে আতঙ্ক ও আত্মসমীক্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।