সংসদে ‘বন্দে মাতরম’ বিতর্কে বিরোধীদের কটাক্ষের জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

Story by  Debkishor Chakraborty | Posted by  Aparna Das • 8 d ago
সংসদে ‘বন্দে মাতরম’ বিতর্কে বিরোধীদের কটাক্ষের জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
সংসদে ‘বন্দে মাতরম’ বিতর্কে বিরোধীদের কটাক্ষের জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
 
দেবকিশোর চক্রবর্তী 

সংসদ অধিবেশনে ‘বন্দে মাতরম’-এর ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ আলোচনার মধ্যেই গানটি নিয়ে বিরোধীদের কটাক্ষের জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সোমবার লোকসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা ইতিহাস জানে না, তারাই গানটিকে বিভাজনের চশমা দিয়ে দেখে। ‘বন্দে মাতরম’ জাতির আত্মা, এটি কখনও বিভেদের প্রতীক হতে পারে না।”
 
প্রধানমন্ত্রী আরও অভিযোগ তোলেন, ১৯৩৭ সালে গানটির মূল কয়েকটি স্তবক বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভারতের জাতীয় ঐক্যের চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। তাঁর দাবি, তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘রাজনৈতিক আপস’-এর যুক্তিতে গানটিকে খণ্ডিত রূপে গ্রহণ করেছিল, যা পরবর্তীকালে বিভাজনের মানসিকতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
 

স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘বন্দে মাতরম’-এর অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গানটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মনোবল জুগিয়েছিল এবং ভারতের বৈচিত্র্যময় সমাজকে একসূত্রে বেঁধেছিল। তাঁর বক্তব্য, “আজ যারা গানটির বিরোধিতা করছে, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ভুলে গেছে। ব্রিটিশরা এই গান নিষিদ্ধ করেছিল; কারণ এটি শক্তির প্রতীক, দমনের নয়, মুক্তির।”
 
প্রধানমন্ত্রী আরও উল্লেখ করেন, সংসদের আলোচনায় গানটির সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থান নতুনভাবে বিশ্লেষণ করা উচিত। বিতর্ক নয়, বরং ঐতিহ্যের মর্যাদা রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
 
বিরোধী দলগুলো, বিশেষত কংগ্রেস, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। তাঁদের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসকে ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছেন এবং অতীতের সিদ্ধান্তকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছেন।
 
বিরোধীদের যুক্তি, ১৯৩৭ সালে গানটির দুই স্তবক সরকারি অনুষ্ঠানে গাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বৃহত্তর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থে। তাঁদের অভিযোগ, “গানটির মর্যাদা নিয়ে ভারতবর্ষে কখনও প্রশ্ন ওঠেনি; সেটিকে রাজনৈতিক রঙ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
 
রাজ্যসভায়ও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া শোনা যায়। বিরোধী সদস্যদের দাবি, সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে ঐতিহাসিক আলোচনাকে রাজনৈতিক সংঘাতে পরিণত করছে। কয়েকজন সংখ্যালঘু সদস্য বলেন, গানটিকে জোর করে ‘নাগরিক কর্তব্য’ হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়; ‘বন্দে মাতরম’ উপলব্ধির বিষয়, বাধ্যবাধকতার নয়। গানটির ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ বছর লোকসভা ও রাজ্যসভায় দশ ঘণ্টার বিশেষ আলোচনা নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সংসদে আলোচনার সূচনা মুহূর্ত থেকেই বিরোধী ও সরকার পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
 
শীতকালীন লোকসভার অধিবেশনের এক দৃশ্য
 
ঐতিহাসিকভাবে ‘বন্দে মাতরম’-এর কয়েকটি স্তবক ধর্মীয় চিত্রকল্প ও প্রতীকের কারণে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। সমাজের একাংশ মনে করে, কিছু অংশ ধর্মীয় প্রতীকের সঙ্গে যুক্ত, অন্যদিকে বহু মানুষের মতে গানটি মাতৃভূমির প্রতি ভক্তি ও সম্মানের প্রতীক, যার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নেই। এই বৈপরীত্যকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ বিষয়টিকে নতুন করে উত্তপ্ত করেছে বলে মনে করছেন সংসদীয় পর্যবেক্ষকেরা।
 
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী মোদির বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, সরকার ‘বন্দে মাতরম’-কে শুধুই সাংস্কৃতিক প্রতীক নয়, জাতীয় চেতনার ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। অপরদিকে বিরোধী শিবিরের আশঙ্কা, গানটির অসমাপ্ত ঐতিহাসিক বিতর্ককে সামনে রেখে সরকার আবারও জাতীয়তাবাদী আবেগকে রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
 
ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ‘বন্দে মাতরম’ এক অনন্য স্থানে রয়েছে। এটি স্বাধীনতা সংগ্রামের আবেগময় অধ্যায়ের প্রতীক। তবে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও বিভাজনের প্রশ্নের সঙ্গে গানটির নাম জড়িয়ে পড়লে তার মূল অর্থ, জাতীয় ঐক্য, আচরণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন পর্যবেক্ষকেরা।
 
সংসদের বিশেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের পর ‘বন্দে মাতরম’কে কেন্দ্র করে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধীদের কটাক্ষের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসের একটি পুরোনো অধ্যায় সামনে আনলেন, যা আবারও বর্তমান রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। আগামী দিনের সংসদীয় আলোচনা এবং রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াই নির্ধারণ করবে, এই বিতর্ক সাংস্কৃতিক মূল্যায়নের পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি নির্বাচনী রাজনীতির নতুন অক্ষরেখা নির্মাণ করবে।