ধর্ম নয় মানুষের পাশে মানুষ, কিস্তওয়ারে মানবতার অনন্য নজির

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 6 d ago
ধর্মের সীমা ছাড়িয়ে, মানবতার রক্ষক : কিস্তওয়ারের ট্র্যাজেডি এবং করুণার গল্প
ধর্মের সীমা ছাড়িয়ে, মানবতার রক্ষক : কিস্তওয়ারের ট্র্যাজেডি এবং করুণার গল্প
 
দানিশ আলি, শ্রীনগর

১৪ই আগস্ট সকালবেলা চিসোটি গ্রামের আকাশে ভক্তিভাব, সাম্প্রদায়িক  আনন্দ আর ধর্মীয় উচ্ছ্বাসের অনুরণন শোনা যাচ্ছিল। কিস্তওয়ারের পাড্ডার এলাকায় অবস্থিত এই শতাব্দীপ্রাচীন গ্রামটি মচাইল মাতার যাত্রার মোটরযান চলার শেষ  স্তর, যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্ত দর্শনের উদ্দেশ্যে থামেন। সকালবেলা জয়ধ্বনি আর লঙ্গরের ব্যস্ততায় মুখর ছিল এই গ্রামটি, কিন্তু দুপুর হতেই তা চিৎকার ও ধ্বংসের চিত্রে পরিণত হয়ে যায়।
 
এক ভয়াবহ মেঘভাঙা বৃষ্টির ঘটনা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই চিসোটি গ্রামকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দেয়। পানি আর পাথরের দেয়াল সবকিছু ভেঙে পড়ে এবং যেসব কিছু তার পথে পড়েছিল, সবকিছু গিলে ফেলে। মন্দির, অস্থায়ী আশ্রয়, দোকানপাট এবং শত শত জীবন, সবকিছু চিনাব নদীর উন্মত্ত স্রোতে বিলীন হয়ে যায়। এই ভয়ানক বিপর্যয়ে এখন পর্যন্ত ৬৫ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে দুইজন পুরোহিতও রয়েছেন। আহত হয়েছেন ১০০-রও বেশি মানুষ এবং প্রায় ৭০ জন ভক্ত এখনো নিখোঁজ।
 
কাশ্মীরের সংকটে ঐক্যবদ্ধ সাধারণ মানুষ
 
“আমরা পালানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু জলের স্রোত খুবই তীব্র ছিল...”
 
এই কথা বলছিলেন সেই সহস্রাধিক তীর্থযাত্রীদের একজন, যারা সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। প্রায় ২,৫০০ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দিকবিদিক ছুটতে থাকেন। ২২ বছর বয়সি সাওয়ান্ত সিং ভেঙে পড়া তার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “যখন বন্যা আসে, মা আর বোন রুটি বিক্রি করছিল। দু’জনেই ভেসে যায়।”
 
তার মতো শত শত পরিবারের জন্য, যারা প্রতি বছর তীর্থযাত্রীদের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন, এই দুর্ঘটনা শুধু জীবনের উপার্জন হারানোর নয়, বরং প্রিয়জন হারানোর এক অপূরণীয় বেদনা, যাকে কোনো শব্দে ব্যাখ্যা করা যায় না।
 
“এমন ধ্বংস আমরা আগে কখনও দেখিনি”
 
ডোডা জেলার ৩৭ বছর বয়সি ওমর ইকবাল উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা ৬৩টি মৃতদেহ উদ্ধার করেছি। শত বছরের পুরনো গ্রামটি কয়েক মিনিটের মধ্যেই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।”
জম্মুর সরকারি মেডিকেল কলেজ (GMC) হাসপাতালের করিডোর আহত, তাদের আত্মীয় এবং স্বেচ্ছাসেবকদের ভিড়ে পরিপূর্ণ। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, ৭৫ জনের বেশি আহতকে ভর্তি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মর্গে ১১টি মৃতদেহ ও একটি অঙ্গ রাখা হয়েছে, যা পরে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
 
“এটা এমন এক দৃশ্য ছিল, যা কারো কখনো দেখা উচিত নয়”
 
৪৩ বছর বয়সি ডাক্তার মুজতবা আহমদ, যিনি প্রথম উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে গ্রামে পৌঁছেছিলেন, গভীর আবেগের সঙ্গে সেই বিপর্যয়ের ভয়াবহতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “যখন আমি সেখানে পৌঁছাই, তখন ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মৃতদেহ, ভেঙে পড়া কুঁড়েঘর, আর্তনাদরত স্বজনদের দৃশ্য সহ্য করা দুঃসহ ছিল। আমি এক ভাইকে দেখেছি, যে তার বোনের মৃতদেহ খুঁজছিল। এক পিতাকে দেখেছি, যিনি ধ্বংসস্তূপের ভেতরে ছেলেকে খুঁজছিলেন।”
 
তিনি আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, “আমাকে সেখান থেকে চলে আসতে হয়েছে। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। সেই পরিবারগুলোর চিৎকার হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল।” তিনি আরও জানান যে খারাপ আবহাওয়ার কারণে উদ্ধারকাজে বারবার বিঘ্ন ঘটছে। এটি এক-দু’দিনে শেষ হওয়ার কাজ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী একটি প্রক্রিয়া।
 
উদ্ধার অভিযানের সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী
 
মানবতার দৃষ্টান্ত: যেখানে ধর্ম বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি
 
এই ভয়াবহ দুর্যোগে আশার আলো হয়ে উঠেছে মুসলিম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি যেমন—আবাবীল ও ফুরকান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। তারা শুধু আহতদের সাহায্য করেনি, বরং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য জীবনরক্ষার আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
 
আবাবীল-এর স্বেচ্ছাসেবক বশীর আহমদ জানান, “আমরা আহতদের জন্য রক্তদান করেছি, খাবারের ব্যবস্থা করেছি, মৃতদেহগুলো গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছি, এমনকি শেষকৃত্যেও সাহায্য করেছি। এটা ধর্মের নয়, মানবতার সেবা করার সময়।”
 
এই সংগঠনগুলি হাসপাতালগুলিতে কমিউনিটি রান্নাঘর চালু করেছে, মৃতদেহের জন্য কাফনের ব্যবস্থা করেছে এবং দূর-দূরান্তের গ্রামে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছেছে। যখন প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি, তখন এই সাহায্যের হাত ধর্মের সীমানা পেরিয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
রাজ্য ও সেনাবাহিনীর তৎপরতা
 
এই দুর্যোগের পর স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, NDRF, SDRF এবং অন্যান্য বাহিনী মিলিতভাবে অনন্য সাহসিকতা ও দ্রুততা প্রদর্শন করেছে। সেনাবাহিনীর ১৭ নম্বর ন্যাশনাল রাইফেলস পাহাড়ি এলাকায় সেতু নির্মাণ করে ত্রাণ কার্যক্রমে গতি আনে। স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা, বিশেষ করে এআরটিও তাসলিম, চব্বিশ ঘণ্টা মাঠে ছিলেন। ওমর ইকবাল বলেন, “প্রশাসন ও এনজিও একসঙ্গে অসাধারণ কাজ করছে। এই ঐক্য সত্যিই অভূতপূর্ব।”
 
এক তীর্থযাত্রা, যা চিরকাল মনে থাকবে

মচাইল মাতা যাত্রা, যা প্রতি বছর এক ধর্মীয় উৎসবের প্রতীক হয়ে উঠত, এবার তা পরিণত হয়েছে শোক ও শ্রদ্ধার এক স্মারকে। এই তীর্থযাত্রা যুগের পর যুগ ধরে জম্মু-কাশ্মীরের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একসূত্রে বেঁধেছে, কিন্তু এবার তা এক ভিন্ন বার্তা নিয়ে এসেছে, করুণা, ঐক্য এবং মানবতার।
 
চিসোটিতে বিধ্বস্ত পরিবেশ হতবাক গ্রামবাসী 
 
যখন মন্দির ভেসে গেল, দোকান মাটির নিচে চাপা পড়ে গেল এবং উপত্যকা শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল, তখন ধর্মের প্রাচীরগুলো ভেঙে পড়ল, আর একটিমাত্র ধর্ম টিকে রইল, মানবতার ধর্ম। 
 
কিস্তওয়ারের  এই বিপর্যয় আমাদের এক অমোচনীয় শিক্ষা দেয়: বিপর্যয় যত বড়ই হোক না কেন, যদি মানবতা বেঁচে থাকে, তাহলে আশার আলো কখনো নিভে যায় না।