অবহেলায় জীর্ণ হয়ে পড়েছে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের "বন্দেমাতরম ভবন"
দেবকিশোর চক্রবর্তী
বাংলা সাহিত্য আর জাতীয় চেতনার গর্ব “বন্দে মাতরম্”-এর স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে চুঁচুড়ার ঐতিহাসিক বন্দেমাতরম ভবন। কিন্তু আজ সেই ভবন পড়ে আছে ভগ্নদশায়। বছরের পর বছর কোনো সংস্কার না হওয়ায় দেওয়াল ফেটে গেছে, ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ছে, দরজা-জানালাও ভেঙে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ আমলে এটি ছিল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দফতর। এখানেই চাকরি করতেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। সরকারি দায়িত্বের পাশাপাশি এখানেই তিনি সাহিত্যচর্চা করতেন। ইতিহাসবিদদের মতে, এই ভবনেই তাঁর মনে জন্ম নেয় দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা—যার ফলশ্রুতিতেই লেখা হয় অমর গান “বন্দে মাতরম্”। পরে এই গানই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় লাখো মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছিল।
কিন্তু আজ সেই ঐতিহ্যবাহী ভবনের চিত্র দুঃখজনক। চারপাশে আগাছা, ছাদের প্লাস্টার ঝরে পড়ছে, ঘরের ভেতর ময়লা ও ধুলোয় ভরে গেছে। স্থানীয় মানুষজন বলছেন, এত বড় ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন অথচ দেখাশোনার কেউ নেই।
চুঁচুড়ার এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, “আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, এখানে বঙ্কিমচন্দ্র চাকরি করতেন। এখন ভবনটা দেখলে খারাপ লাগে। কেউ যেন আর এর খোঁজই নেয় না।”
পুরসভা সূত্রে জানা গেছে, রাজ্য সরকারের কাছে ভবনটি সংস্কারের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এক পুরসভা কর্মকর্তা বলেন, “সংস্কৃতি দফতর ও পর্যটন দফতরের সহযোগিতা পেলে দ্রুত কাজ শুরু করা যাবে।”
স্থানীয় ইতিহাসপ্রেমী ও শিক্ষকরা চান, ভবনটিকে সংরক্ষিত ঐতিহ্য স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করা হোক। তাঁদের মতে, এখানে যদি একটি ছোট বঙ্কিম স্মৃতি জাদুঘর তৈরি হয়, তবে শিক্ষার্থীরা কাছ থেকে জানতে পারবে বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন, সাহিত্য ও দেশপ্রেমের ইতিহাস।
প্রতিবছর বহু স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী এখানে আসে। কিন্তু ভবনের জীর্ণ চেহারা দেখে অনেকেই হতাশ হয়। এক শিক্ষক বলেন, “এটা শুধু একটা পুরোনো ভবন নয়, এটা আমাদের জাতীয় গৌরবের প্রতীক। এই অবস্থায় ফেলে রাখা সত্যিই দুঃখজনক।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই স্থানটিকে সংস্কার করে পর্যটন মানচিত্রে আনা সম্ভব। এতে যেমন ইতিহাস রক্ষা পাবে, তেমনই এলাকায় কর্মসংস্থান ও পর্যটনের সুযোগও বাড়বে।
কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই ভবনটি ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে। যদি এখনই সংস্কারের ব্যবস্থা না হয়, তবে অচিরেই হারিয়ে যেতে পারে বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতি-বিজড়িত এই ঐতিহাসিক স্থাপনা।
আজও যখন আমরা “বন্দে মাতরম্” উচ্চারণে গর্ববোধ করি, তখন প্রশ্ন জাগে—আমরা কি সত্যিই সেই স্রষ্টার স্মৃতিকে যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছি?