দেব কিশোর চক্রবর্তী
এসআইআর পরবর্তী সময়ে সীমান্ত এলাকায় বাড়ছে উদ্বেগ। দিন কয়েক আগেই হাকিমপুর সীমান্তে দেখা গিয়েছিল, বহু বাংলাদেশি নাগরিক নিজ দেশে ফেরার অপেক্ষায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। রাজ্যের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এই মানুষদের ওপর এখন বাড়ছে প্রশাসনিক নজরদারি ও রাজনৈতিক চাপ— আর এই চাপে দেশে ফেরার প্রবণতাও যেন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই ঘটনাপ্রবাহেরই প্রতিফলন মিলল উত্তর ২৪ পরগনার মধ্যমগ্রামে, যেখানে এক রাতের মধ্যেই উধাও হয়ে গেল দেড়শোর বেশি পরিবার।
রবিবার সকালে উত্তর ২৪ পরগনার Madhyamgram-এর পাটুলি মাঠাপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, যে বিস্তীর্ণ এলাকায় এতদিন ধরে বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে গড়ে তোলা ছিল বিশাল অস্থায়ী বসতি—সেই জায়গাজুড়ে এখন কেবল কঙ্কালসার কাঠামো। কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই, উধাও সব পরিবার। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত কয়েক মাস ধরে প্রায় দেড়শো পরিবার ওই এলাকায় থাকতেন। তাঁরা বেশিরভাগই দিনমজুরির কাজ করতেন—কেউ রাজমিস্ত্রির সহকারী, কেউ বা অন্য শ্রমের কাজ। এলাকার বহু বাড়িতে তাঁদের পরিবারের মহিলারাও গৃহকর্মীর দায়িত্ব সামলাতেন।
এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, কখনওই তারা নিশ্চিতভাবে জানতে পারেননি ওইসব মানুষের সঠিক পরিচয়। অনেকের ভাষাতেই বাংলাদেশি উচ্চারণ, আবার তাদের বক্তব্যেও মিলেছিল সীমান্ত পার হয়ে এক সময় বর্তমান রাজ্যে এসে কাজ নেওয়ার প্রসঙ্গ। তবে হঠাৎই কেন এত পরিবার একসঙ্গে এলাকা ছাড়লেন, তা নিয়ে চরম ধন্দ তৈরি হয়েছে। পাটুলি মাঠাপাড়া ছাড়ার আগের রাতে এলাকার কেউই কোনো অস্বাভাবিক নড়াচড়া টের পাননি।
এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, “শনিবার রাতেও আলো জ্বলছিল, রান্নার ধোঁয়াও দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু রবিবার সকালে উঠে দেখি—ঘর আছে, মানুষ নেই। এমন পরিস্থিতি আগে কোনও দিন দেখিনি।” আরেকজন বলেন, “ওরা নিজেদের কাগজপত্র দেখাতে চাইত না। কেউ প্রশ্ন করলে বলত, ‘কাজ করছি, থাকতে দাও।’ কিন্তু এতদিন কাজ করেও এক রাতেই কোথায় চলে গেল—বোঝা যাচ্ছে না।”
স্থানীয় সূত্রের মতে, সম্প্রতি এসআইআর নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় এইসব পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেকেই নাকি বলছিলেন, রাজ্যের ভেতরে বসবাস আর নিরাপদ নয়। সীমান্ত লাগোয়া বিভিন্ন এলাকায় যেমন ক্রমশ নজরদারি বাড়ছে, হঠাৎ তল্লাশি বা পরিচয় যাচাইয়ের আশঙ্কায় তাঁরা নিরাপদ রাস্তা ধরে সীমান্তের দিকে রওনা হয়েছেন বলেই সন্দেহ।
এই প্রসঙ্গে হাকিমপুর সীমান্তে কয়েকদিন আগের ঘটনার উল্লেখ আসে—যেখানে শতাধিক বাংলাদেশি সীমান্তে জড়ো হয়ে দেশে ফেরার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁদের অনেকেই জানিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করতেন। কিন্তু এসআইআর পরবর্তী ‘চাপ’ বাড়ায় তাঁদের মনে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এবার ঠিক তেমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মধ্যমগ্রামেও।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ঘটনার খবর পেয়ে এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। যদিও উধাও হওয়া পরিবারগুলির পরিচয়, তাদের সঠিক বাসস্থান বা তারা আদৌ বাংলাদেশি কি না—তা আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওইসব মানুষদের উপস্থিতি নিয়ে আগে থেকেই কিছু অভিযোগ ছিল, তবে তারা কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবুও এত বড় সংখ্যায় লোক গায়েব হয়ে যাওয়া তদন্তের দাবি রাখে।
এদিকে, স্থানীয়দের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে। তাঁদের প্রশ্ন—যদি সত্যিই তারা বাংলাদেশি হন, তবে কীভাবে এতদিন ধরে কোনো নথি ছাড়া এখানে বাস করছিলেন? আর যদি অন্য কোনো কারণে এলাকা ছাড়েন, সেই কারণই বা কী?
পাটুলি মাঠাপাড়াজুড়ে এখন কেবল পরিত্যক্ত বাঁশের ঘর ও খালি ত্রিপলগুলো পড়ে আছে, যেন এক রাতেই জীবনের সব চিহ্ন মুছে গেছে। এলাকাবাসীর অনুমান, এসআইআরের চাপ ও সীমান্ত পরিস্থিতির পরিবর্তনই হয়তো এই হঠাৎ প্রস্থানের কারণ। তবে প্রশাসনের নিশ্চিত তদন্তের আগ পর্যন্ত অনুমানই ভরসা।
মধ্যমগ্রামের মানুষ এখন তাকিয়ে আছে—কবে মিলবে উত্তর, কেন এমন রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেল দেড়শো পরিবার?