এক ভিন্নধর্মী পূজো রামকৃষ্ণ মিশন সোহরার শেল্লার ও নর্তিয়াংয়ের দুর্গাপূজো

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 7 d ago
নর্তিয়াং দুর্গা মন্দির
নর্তিয়াং দুর্গা মন্দির
মেঘালয়
 
মেঘালয়ের দুই বিশেষ দুর্গাপূজার ঐতিহ্য — একদিকে খাসি পাহাড়ের কোলের শান্ত আদিবাসী গ্রাম শেল্লা, অন্যদিকে শক্তিপীঠ নর্তিয়াংয়ের প্রাচীন মন্দির — যেখানে পূজা কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং সংস্কৃতি, সমাজ ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।

খাসি পাহাড়ের কোলে অবস্থিত মেঘালয়ের এক শান্ত গ্রাম শেল্লায় পরম্পরাগত এক অনন্য দুর্গা পূজোর পরম্পরা। ১৯৩১ সাল থেকে রামকৃষ্ণ মিশন এখানে উমিয়াম নদীর তীরে এই উৎসব পালন করে আসছে । এটি ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতে মিশনের প্রথম দুর্গা পূজা।

স্বামী প্রভানন্দজীর দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে এই পূজা ভক্তি,সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের এক অপূর্ব মেলবন্ধন । বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত সমস্ত আচার,হৃদয়স্পর্শী সঙ্গীত,শিশুদের পরিবেশনা এবং স্থানীয় মানুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এই পূজোকে করে তোলে আরও বিশেষ।

সোহরা রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের শেল্লা উপকেন্দ্রে আয়োজিত দুর্গাপূজো সমগ্র অঞ্চলে একটি সুপরিচিত ঐতিহ্যবাহী উৎসব হিসেবে পরিচিত।এই মনোরম নদীতীরবর্তী আদিবাসী গ্রামটি দুর্গাপূজো ও কালীপূজো (দীপাবলির সঙ্গে) উপলক্ষে উৎসাহ ও আনন্দে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তারই পাশাপাশি এই পূজোর সময় অধিকাংশ প্রবাসী গ্রামবাসী নিজেদের ঘরে ফিরে আসেন। সঙ্গীত,প্রার্থনা,ভক্তিগীতি,পৌরাণিক নাটক, প্রদীপ ও আতশবাজি—সবকিছুই মানুষের আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করে।সারা গ্রামজুড়ে নতুন পোশাকে শিশু ও তাদের অভিভাবকদের আনন্দঘন উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো হয়।পূজোর সব আয়োজন—ফল সাজানো থেকে শুরু করে ভোগ রান্না পর্যন্ত—সবই এই আদিবাসী ভক্তরাই নিজেরা সম্পূর্ণ করেন।

বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় ভক্তদের প্রার্থনা ও অশ্রুসজল চোখে প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য সত্যিই এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য, যা না দেখলে বোঝা যায় না  ।
 
অন্যদিকে  নর্তিয়াং দুর্গা মন্দিরে, যা রাজ্যের পশ্চিম জয়ন্তিয়া পাহাড়ে অবস্থিত এবং প্রায় ৬০০ বছরের প্রাচীন। এই মন্দিরটি কামাখ্যা মন্দিরের মতোই একটি শক্তি পীঠ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্বাস করা হয়, জয়ন্তিয়া পাহাড়ে দেবীর বাম উরু পতিত হয়েছিল এবং সেই স্থানেই নর্তিয়াং মন্দিরের অবস্থান।জয়ন্তিয়া রাজবংশের আরাধ্যা দেবী ছিলেন জয়ন্তেশ্বরী,যিনি ধর্মেরও এক মুল দেবতা। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের পনার  জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করেন, নিয়মত্রে ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত এক ধর্ম, যার মূল ভিত্তি ছিল সৎ জীবিকা, মানবতার প্রতি সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং পিতামাতার বংশের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা।নিয়মত্রে ধর্মে মাতৃদেবীর পূজা করা হত,যা পরে সনাতন ধর্মের শক্তি আরাধনার সঙ্গে মিশে যায়।

কারণ প্রাচীন নিয়মত্রে ধর্মে কোনো মূর্তিপূজার প্রথা ছিল না,সেই ঐতিহ্য আজও বজায় রয়েছে। দুর্গাপূজোর সময় মূর্তির পরিবর্তে একটি কাঁঠালের (বা কলাগাছের) গাছের গুঁড়ি মা দুর্গার প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়।
 
এই মন্দিরে পূজার আচার-অনুষ্ঠান সমতলের প্রচলিত হিন্দু রীতিনীতির মতো নয়; বরং এখানে হিন্দু ও প্রাচীন খাসি ঐতিহ্যের এক অনন্য মিশ্রণ দেখা যায়। স্থানীয় মুখিয়া বা সিয়েম -কে এই মন্দিরের প্রধান রক্ষক বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গণ্য করা হয়।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, জয়ন্তিয়া রাজ্যের মানুষ প্রথাগত হিন্দু পূজোর আচার সম্পর্কে সুপরিচিত ছিলেন না। আশেপাশের এলাকা—বাংলাদেশ বা অসম থেকে—যথাযথ ব্রাহ্মণ না পাওয়ায়, পূজোর আচার পরিচালনার জন্য রাজারা পশ্চিম ভারত থেকে দেশমুখ ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ জানান।

জয়ন্তিয়া রাজারা এক সময়ে নরবলি দেওয়ার প্রথা পালন করতেন বলে কথিত আছে। যদিও এখন সেই নরবলির প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, তার পরিবর্তে অষ্টমীর দিনে পশুবলি—বিশেষ করে ছাগল ও হাঁস—দেওয়া হয়।দুর্গাপূজার সময়, দেশের নানা প্রান্ত থেকে বহু তীর্থযাত্রী এই মন্দিরে আসেন। আজও অষ্টমীরদিনে সিয়েম নিজ হাতে ছাগল বলি দেন যা এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বহন করে।

 
 
এটি শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি এক জীবন্ত ঐতিহ্য যেখানে বিশ্বাস ও সেবাব্রত একত্রে মিলিত হয়েছে।