শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো গুলির মধ্যে অন্যতম একটি পুজো হলো দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরের মল্লিক বাড়ির পুজো। বিশিষ্ট অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক ও অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিকের বাড়ির পুজো । এবার ১০১-এ পা দিল মল্লিক বাড়ির দুর্গা পুজো। এ বিষয়ে সরাসরি আওয়াজ দ্য ভয়েসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রঞ্জিত মল্লিকের মেয়ে তথা অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিক তুলে ধরেন বাড়ির পুজোর বিশেষত্ব, আচার-নীতি এবং সংস্কার যা তিনি ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেন নিজের দুই সন্তানের মধ্যেও। ছোট বেলা থেকে তাঁর দেখা পুজো , সেটার অনুভূতি, আনন্দ এখন কতটা বর্তমান সেটা বলতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়েন অভিনেত্রী।
দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'মা দুর্গা আসছেন। এইটুকুতেই মন খুশিতে ভরে ওঠে। মা এসে সবার সবটা ভালো করেন। প্রস্তুতিও জোরকদমে চলছে।' এ বছর তিনি এক নামী চ্যানেলে মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারের জন্য তৈরি এক অনুষ্ঠানে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে অভিনয় করেছেন।
১০৮ টি রুপোর পদ্মে সাজানো মা
এই ভূমিকায় অভিনয় করতে আলাদা কোনও অনুভূতি হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার এবছর মহিষাসুরমর্দিনী রূপে হ্যাটট্রিক। যখনই মহিষাসুরমর্দিনী হয়ে পর্দায় আসি অন্তর থেকে একটা আলাদা শক্তি অনুভব করি। মনে হয় সেই শুভ শক্তি সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক। চারিদিকে সব অশুভর বিনাশ হোক। বিভিন্ন রকম চরিত্র করি কিন্তু এই চরিত্রটা আলাদা। মা দুর্গা তো স্বয়ংসম্পূর্ণা। প্রত্যেক নারীই দশভুজা।'
মল্লিক বাড়ির দুর্গাপুজোর বিশেষ নিয়ম, রীতি, আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের মল্লিক বাড়ির দুর্গাপুজো এবার ১০১ বছরে পদার্পণ করল। বনেদি বাড়িতে যেভাবে পুজো হয় আমাদেরও সেই নিয়ম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করা হয়। নির্ঘণ্টের দিকে খেয়াল রাখা হয়। পুজো মানেই ভোগ, নারকেল নাড়ু। পুজোর ক’টা দিন আমাদের বাড়িতে নিরামিষ খাওয়া হয়। বিসর্জনের পর আমরা আমিষ খাই। মেটে চচ্চড়ি রান্না হয়। এটা মল্লিক বাড়ির বিশেষত্ব। এই মেটে চচ্চড়ির স্বাদ অতুলনীয়।'
পুজোর প্রথম উদ্যোক্তা রাধাগোবিন্দ মল্লিকের বাড়ির দুর্গা দালান
তবে তিনি এটাও স্বীকার করে নেন যে এখন অনুভূতি, ভাবনা, উৎসাহ অনেকটাই তাঁর ছোটবেলার তুলনায় আলাদা। বাচ্চারা আজকাল পুজোর আগের 'পুজো পুজো' ভাবটা অন্তরে অনুভব করে না। তার জন্য অবশ্য তিনি অভিভাবকদেরই দায়ী করলেন। তিনি বলেন, 'আজকের জেট যুগে মানুষ এতটাই কর্মব্যস্ত যে সন্তানকে এসবের আনন্দ উপভোগের জন্য সময় করে দিতে পারে না। তাই সন্তানও এসব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।' তবে নিজের দুই সন্তানকে তিনি যতটা সম্ভব এসবের সঙ্গে জুড়ে রাখতে চেষ্টা করেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, 'আমার সন্তানদের নিয়ে পরিবারের সঙ্গে পুজো কাটাই। আমার মনে হয় সন্তানরা মায়েদের দেখেই শেখে। পুজোর সময় মল্লিক বাড়িতে যাওয়ার জন্য আমি এতটাই অপেক্ষায় থাকি, আমার ছেলে কবীর এটা খুব ভালো করে লক্ষ্য করে। আমার মেয়ের এবছর প্রথম পুজো। পুজোর সময় আমার বাবাও যেমন তাঁর ছোটবেলায় ফিরে যান, আমিও আমার ছোটবেলায় ফিরে যাই। তখন কোনদিন কোন জামা পরব, সেগুলো হিসেব করতাম। আমি আমার সন্তানদের মধ্যে এই ভাবনাটা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। ছেলে কবীর এখন অনেকটাই এটা অনুভব করে।' তিনি আরও বলেন, 'আমার দুই সন্তান এখনও খুব ছোট। আমি চেষ্টা করি যাতে ওদের ভবিষ্যৎটা খুব ভালো হয়। বর্তমানে ওদের খুব সুন্দর একটা পরিবেশে বড় হওয়ার সুযোগ যেন করে দিতে পারি। আমি চাই ওরা সবার আগে খুব ভালো মানুষ হোক। তার জন্য সব রকম নেগেটিভিটি থেকে ওদের দূরে রাখি।'
বাড়ির পুজোয় মা, বাবা ও স্বামীর সঙ্গে কোয়েল
পুজোর ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'মল্লিক বাড়ির পুজোর সূচনা আমাদের পূর্বপুরুষ রাধাগোবিন্দ মল্লিকের হাত ধরে গুপ্তিপাড়ায় হলেও পরবর্তীকালে তারা ভবানীপুর এলাকায় চলে আসার পর রাধাগোবিন্দ মল্লিকের পুত্র সুরেন্দ্র মাধব মল্লিকের হাত ধরে এই বাড়িতেই পুনরায় মায়ের পুজো শুরু হয় ১৯২৪ সালে। সুরেন্দ্র মাধবরা ছিলেন সাত ভাই। সকলে মিলে একসঙ্গেই মেতে ওঠেন পুজোয়।' তিনি আরও বলেন, 'মল্লিক বাড়ির দুর্গা পুজোয় প্রতিবছর রুপোর ১০৮টি পদ্ম ফুলে সাজানো হয় মাকে। সেই প্রথম বছর থেকে এই নিয়ম চলে আসছে যা আজও অপরিবর্তনীয়। শুধু তাই নয়, পুজোর সময় প্রতিদিন নিয়ম করে মায়ের গলার ফুলের মালা বললে নতুন মালা দেওয়া হয়। তাও আবার এক একদিন এক একটি আলাদা আলাদা ফুলের মালা।'
তিনি বলেন, 'মল্লিক বাড়ির পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। এ বাড়িতে পুজোয় কোন বলি প্রথা নেই। প্রতি বছর জন্মাষ্টমীর পরের দিন এ বাড়িতে মায়ের কাঠামো পুজো হয় এবং তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রতিমা নির্মাণের কাজ। এ বাড়ির প্রতিমা হয় একচালার। মাকে সাজানো হয় ডাকের সাজে। এবছরও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হবে না।'