শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায়, সেই একই মঞ্চে আবার দেখা হল দুজনার। কলকাতার কলা মন্দিরের প্রেক্ষাগৃহে সম্প্রতি পাশাপাশি বসলেন দুজন। কথা হল, গান হল, সুরের ঢেউ খেলে গেল সর্বত্র। আর অনেক বছর পর; হ্যাঁ অনেক বছরই বটে, দীর্ঘ পনেরো বছর পর জমিয়ে আড্ডা- গান-সুরের মুর্ছনায় ভাসলেন এবং দর্শক আসনের প্রত্যেককে মাতিয়ে রাখলেন দুই বন্ধু। দুজনে দুজনার ভালো মন্দের খোঁজ নিলেন।
হায় পথে হল ছাড়াছাড়ি গেলাম কে কোথায়?/ আবার দেখা যদি হল সখা, প্রাণের মাঝে আয়…
আর এর পর গানে গানে মাত করে দিলেন বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যের জলসা। এই দুজন হলেন আশির দশকের একদম শেষ দিকে ধুঁকতে থাকা বাংলা গানের মরা গাঙে বান ডেকে আনা দুই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী , যাদের স্বতন্ত্র গায়কি আজও একইরকম জনপ্রিয়, সঙ্গীত জগতের সেই দুই দিকপাল, সুমন-অঞ্জন। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। একজন কবীর সুমন ও আরেকজন অঞ্জন দত্ত।
গভীর কথা, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কীভাবে উইটের সঙ্গে পরিবেশন করতে হয় সেই ছবি জীবন্ত করে তোলেন দুজনে কলকাতার কলা মন্দিরে। করীর সুমন নকশাল বাড়ি, ফাঁসি দেওয়া থেকে শুরু করে সুদূর ফ্রান্স, জার্মানির দিনগুলোর রেস্ট্রোস্পেক্টিভ তুলে ধরলেন তাঁর গান এবং স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে। তুমুল হাততালির অভিবাদন গোটা প্রেক্ষাগৃহে গুঞ্জরিত হতে থাকে। নব্বইয়ের দশকের আধুনিক বাংলা গানের পুরোধা সুর বাঁধলেন ভালোবাসার হাতে হাত রাখবার আহ্বানে। মন্ত্র মুগ্ধকর সন্ধ্যায় সুমন গেয়ে চলেন, ‘চেনা দুঃখ চেনা সুখ’ থেকে ‘পেটকাটি চাঁদিয়াল’, ‘বাঁশুরিয়া বাঁশি’-র মতন একের পর এক কালজয়ী বাংলা গান।
বন্ধু তথা সহকর্মী গানের জগতে প্রায় সমসাময়িক অঞ্জনের গানের কথার মাধ্যমে বাংলা গান কী করে ফিরে পেলো গুরুগম্ভীর মনোটনি পেরিয়ে বহু কাঙ্ক্ষিত কমিক রিলিফ, বারবার মনে করিয়ে দিলেন সুমন। অঞ্জনের গিটার ‘শুনতে কি চাও’ বলার মাধ্যমে যেন শেকল ভাঙলেন সেই গাম্ভীর্য্যের।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিলেন অঞ্জন পুত্র নীল দত্ত। সুমন আর অঞ্জনের গান আমদের নিত্যদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে কতটা একাত্ম হয়ে রয়েছে তাই এদিন স্পষ্ট করে দেন দুই বন্ধু । একদিকে যেমন ‘স্যামসন’, ‘মৌলালির মালা’, ‘মেরি অ্যান’, ‘জেরেমির বেহালা’ এই প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনী স্বকীয় কণ্ঠে তুলে ধরলেন অঞ্জন অন্যদিকে তেমনি ‘ছেড়েছ তো অনেক কিছুই পুরোনো বোলচাল’ দিয়ে মাতিয়ে দিলেন সুমন।
বাংলা কমেডি গানে চটুল প্যারোডি থাকলেও মজার দিকটা যেন উপেক্ষিতই থেকে গেছিলো বহুকাল। অঞ্জনের গিটার ‘শুনতে কি চাও’ বলার মাধ্যমে যেন শেকল ভাঙলেন সেই গাম্ভীর্য্যের।
অঞ্জন প্রথম সেই মানুষ যিনি তার গানের মাধ্যমে প্রথম বার বাঙালির চোখের সামনে তুলে ধরেন একটা অনামী নোনাধরা কলকাতার ছবি। অন্যদিকে, সুমন আধুনিক জীবনমুখী বাংলা গানের স্পর্শ দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির মননে -চিন্তনে।