শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
আজ মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্মদিন। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে তাঁর অবদান আজও অমলিন। ১৯২৬ সালে কলকাতার আহিরিটোলায় জন্ম নেওয়া অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় পরবর্তীতে উত্তম কুমার নামে পরিচিত হন।
১৯৫৪ সালে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অগ্নিপরীক্ষা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি সাফল্যের শিখরে পৌঁছন। পরবর্তী তিন দশক ধরে সপ্তপদী, হারানো সুর, চৌরঙ্গী, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এবং সত্যজিৎ রায়ের নায়ক সহ বহু ছবিতে তিনি বাংলা সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই অকালপ্রয়াণ হলেও দর্শকের মনে আজও অমর তিনি। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে উত্তম কুমার কেবল অভিনেতা নন, তিনি এক যুগের প্রতীক— “মহানায়ক”।তবে মহানায়ক উত্তম কুমারের জীবন ছিল যেমন সাফল্যের ঝলক, তেমনই ব্যক্তিগত দুঃখ–কষ্টে ভরপুর। তাঁর জীবনের সুখ-দুঃখের দিকগুলো
এক ঝলকেমহানায়কের জীবনে সুখের অধ্যায়
অভিনয় জগতে সাফল্য : ১৯৫৪ সালে অগ্নিপরীক্ষা মুক্তির পর থেকে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার সর্বকালের জনপ্রিয় নায়ক। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তাঁর জুটি দর্শকের কাছে কিংবদন্তি হয়ে ওঠে।
অভিনয়ের বহুমুখিতা : সপ্তপদী, ঝিন্দের বন্দী, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, নায়ক সহ একের পর এক ছবিতে অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ দেন।
জনপ্রিয়তা ও ভালবাসা : শহর থেকে গ্রাম, সর্বত্র মানুষ তাঁকে আপনজনের মতো ভালোবেসেছে। সাধারণ মানুষ তাঁকে ‘মহানায়ক’ নামে অভিহিত করেন।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : সত্যজিৎ রায়ের নায়ক ছবিতে তাঁর অভিনয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মহলে প্রশংসিত হয়।
মহানায়কের জীবনে দুঃখের অধ্যায়
প্রথম দিকের ব্যর্থতা : অভিনয় জীবনের শুরুতে একের পর এক ছবি ব্যর্থ হয়। অনেকেই মনে করতেন তিনি নায়ক হওয়ার উপযুক্ত নন।
ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন : সংসার জীবনে অশান্তি, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন তাঁকে মানসিকভাবে কষ্ট দিয়েছিল।
আত্মীয়–সহকর্মীদের সমালোচনা : জনপ্রিয়তা থাকলেও অনেক সময় সহকর্মীদের ঈর্ষা ও আড়ালে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।
অকাল মৃত্যু : মাত্র ৫৩ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি প্রয়াত হন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি শুটিং চালিয়ে গিয়েছিলেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে উত্তম কুমার শুধু এক নায়ক ছিলেন। না, ছিলেন অভিনেত্রীদের কাছে ভরসার সঙ্গী, সহ-অভিনেতা এবং অনুপ্রেরণার প্রতীক। বিভিন্ন সময়ে সহঅভিনেত্রীরা তাঁর সম্পর্কে যে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন, তা থেকেই বোঝা যায় তাঁর ব্যক্তিত্ব কতটা গভীর ছিল।
সুচিত্রা সেন:
উত্তম–সুচিত্রার জুটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অমর। যদিও সুচিত্রা সেন খুব কমই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তবে ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনয় করতে তাঁর আলাদা স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। দু’জনের রসায়ন এতটাই অনন্য ছিল যে দর্শক তাঁদের বাস্তব জীবনের দম্পতি বলেই ভাবতেন।
সবিতা চৌধুরী
জনপ্রিয় নায়িকা সবিতা চৌধুরী একবার বলেন, “উত্তমদা শুটিং ফ্লোরে সবার সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন। সিনিয়র–জুনিয়রের ভেদাভেদ তাঁর মধ্যে ছিল না। তাই আমরা খুব স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারতাম।”
সুমিত্রা দেবী
অভিনেত্রী সুমিত্রা দেবীর মতে, উত্তম কুমার ছিলেন একেবারে ‘জেন্টলম্যান’। তিনি বলেছিলেন, “ওঁর মধ্যে কোনও অহংকার ছিল না, অথচ উনি ছিলেন তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় তারকা।”
সুপ্রিয়া দেবী
সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমারের ব্যক্তিগত সম্পর্কও আলোচিত ছিল। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, “উত্তম আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উনি ছিলেন শুধু মহানায়ক নন, একজন অসাধারণ মানুষ।”
সন্ধ্যা রায়
সন্ধ্যা রায় মনে করতেন, উত্তম কুমারের মতো সহ-অভিনেতার উপস্থিতি মানেই অভিনয়ে নতুন শক্তি পাওয়া। তাঁর মতে, উত্তম কুমারের অভিনয় এত স্বতঃস্ফূর্ত ছিল যে সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতে গিয়ে অন্য অভিনেতারও মান উন্নত হত।অবশেষে, উত্তম কুমারের জীবন যেন এক পূর্ণাঙ্গ নাটক,যেখানে সাফল্যের আলো যেমন উজ্জ্বল, তেমনি ব্যক্তিগত দুঃখও গভীর। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি আজও অমর, কারণ দর্শকের মনে তাঁর হাসি, আবেগ আর অভিনয় আজও জীবন্ত।