অসমের কণ্ঠ,হাটথ্রব জুবিন গার্গ আর নেই

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 13 d ago
জুবিন গার্গ
জুবিন গার্গ
গুয়াহাটী, 
অসমের কণ্ঠ, অসমিয়ার প্রাণ শিল্পী জুবিন গার্গ আর নেই। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া ফেস্টিভ্যালে যোগদানের উদ্দেশ্যে তিনি গিয়েছিলেন। সেই সফরের মাঝেই শুক্রবার স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সমুদ্রের নিচে অচেতন হয়ে পড়ে যান। তৎক্ষণাৎ তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও চিকিৎসকেরা শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচাতে পারেননি।
 
প্রায় এক ঘণ্টা তিনি আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছিলেন এবং পরে চিকিৎসকেরা তাঁর মৃত্যু ঘোষণা করেন। সিঙ্গাপুর সরকার এই খবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। ভারত সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পবিত্র মার্ঘেরিটা নিশ্চিত করেছেন যে মরদেহ দ্রুত অসমে ফিরিয়ে আনার সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি নিজে এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং শিল্পীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। মরদেহের সঙ্গে নর্থ ইস্ট ফেস্টিভ্যালে উপস্থিত থাকা অন্যান্য শিল্পী ও প্রতিনিধিদেরও দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সঙ্গেও এ বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ চলছে।

এই মর্মান্তিক খবর ছড়িয়ে পড়তেই অসমসহ সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। গানের জাদুতে যিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মুগ্ধ করেছিলেন, তাঁর হঠাৎ চলে যাওয়া যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজার হাজার ভক্ত শোকবার্তা জানাচ্ছেন এবং তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।

১৯৭২ সালের ১৮ নভেম্বর গুয়াহাটীতে জন্মগ্রহণ করেন জুবিন গার্গ। তাঁর বাবা প্রফুল্ল গার্গ এবং মা ইলাবতী গার্গ দুজনেই সংস্কৃতিমনস্ক পরিবার থেকে আসা মানুষ ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ জন্মায়। খুব অল্প বয়সেই তিনি হারমোনিয়াম, গিটার এবং বাঁশি বাজাতে শিখে ফেলেন। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় প্রকাশিত আনামিকা অ্যালবামই তাঁকে রাতারাতি জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করে। এরপরে একের পর এক অ্যালবাম, চলচ্চিত্রের গান ও মঞ্চ পরিবেশনার মাধ্যমে তিনি শুধু অসম নয়, সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের যুবসমাজের কাছে এক অদম্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। অভিজিত, স্নেহবন্ধন, মায়াবিনী– এসব অ্যালবামের গান আজও সমান জনপ্রিয়। অসমীয়া গানের জগতে অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে তিনি বাংলা ও হিন্দি গানেও অসংখ্য শ্রোতার মন জয় করেন। বলিউডে তাঁর “ইয়া আল্লাহ” (গ্যাংস্টার ছবির গান) কিংবা “ক ক ক কিরণ”–এর মতো গান তাঁকে সর্বভারতীয় পরিচিতি এনে দেয়। একদিকে আঞ্চলিক গানের মাটির গন্ধ, অন্যদিকে আধুনিকতার ছোঁয়া—এই দুইয়ের মিশ্রণই তাঁকে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে।

জুবিন গার্গ শুধু কণ্ঠশিল্পী হিসেবেই নন, একজন সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও সমানভাবে প্রশংসিত ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি অসমীয়া চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর কণ্ঠ ও সুরে সজ্জিত অসংখ্য চলচ্চিত্র আজও দর্শক-শ্রোতাদের মনে বেঁচে আছে। তাঁর শিল্পীসত্তা ছিল বহুমাত্রিক। গান দিয়ে যেমন ভক্তদের হৃদয় জয় করেছেন, তেমনি সামাজিক দায়িত্ব পালনেও তিনি পিছপা হননি। পরিবেশ সংরক্ষণ, শিক্ষা বিস্তার, দারিদ্র্য দূরীকরণ, সামাজিক সম্প্রীতি—এমন নানা বিষয়ে তিনি গানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

অসমের সঙ্গীত জগতের পুনর্জাগরণে জুবিন গার্গের ভূমিকা অপরিসীম। তিনি কেবলমাত্র একজন শিল্পী নন, ছিলেন এক সাংস্কৃতিক দূত। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গীত, ভাষা ও সংস্কৃতিকে তিনি ভারতের মূল স্রোতে তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর গান সীমান্ত অতিক্রম করে এক অদৃশ্য বন্ধনের সৃষ্টি করেছে। তরুণ প্রজন্ম থেকে প্রবীণ শ্রোতা—সবাই তাঁর কণ্ঠে সমানভাবে মুগ্ধ ছিলেন।

তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সমগ্র অসম ও উত্তর-পূর্ব ভারতে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক মহল—সবার কাছেই এটি এক অপূরণীয় ক্ষতি। অনেকেই বলেছেন, অসম আজ তার প্রিয় কণ্ঠকে হারাল। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন তাঁর স্মরণে সভা ও প্রার্থনার আয়োজন শুরু করেছে। গুয়াহাটী শহরের বিভিন্ন স্থানে ভক্তরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমবেত হয়ে তাঁর ছবি সামনে ফুল অর্পণ করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #WeMissYouZubeen এবং #ZubeenGargLivesOn ইত্যাদি হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে।

অসম তথা সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের সাংস্কৃতিক আকাশে জুবিন গার্গ ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর গান, তাঁর সুর, তাঁর কণ্ঠ শুধু বিনোদনই দেয়নি, বরং মানুষের মননে আশা, ভালোবাসা ও প্রেরণার জন্ম দিয়েছে। তাঁর হঠাৎ চলে যাওয়া অসমকে এক গভীর শূন্যতায় ফেলে দিল। তবুও তাঁর গান, তাঁর সুর এবং তাঁর শিল্পসত্তা চিরকাল অম্লান থাকবে। আজ সমগ্র অসম কাঁদছে তার প্রিয় কণ্ঠকে হারিয়ে, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটাই কথা—জুবিন গার্গ নেই, তবু তাঁর গান আমাদের মনে চিরকাল বেঁচে থাকবে।

বহু সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। এদিনও তাঁর পারফর্ম করার কথা ছিল সিঙ্গাপুরে ৷ কিন্তু এখন সেই সব অতীত। আর শোনা যাবে না গান জুবিনের সেই জোরালো কন্ঠস্বর। সিঙ্গাপুর থেকে ভারতে ফিরবে অসমের জনপ্রিয় তারকার নিথর দেহ ৷ জুবিনের গান বললেই প্রথমে মনে আসে 'ইয়া আলি'-র কথা ৷ গ্যাংস্টার ছবির এই গান, মুগ্ধ করেছিল সকলকে। অভিনেতা শাইনিকে দেখা গিয়েছিল সেই গানের দৃশ্যে ৷ এতগুলো বছর পরেও এতটুকু ভালোবাসা কমেনি এই গানের প্রতি ৷ হিন্দি-বাংলা মিলিয়ে জুবিন একাধিক সুপারহিট গান উপহার দিয়েছেন ৷