শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ ,কলকাতা :
অসমের মাটিতে জন্ম নেওয়া, অথচ সমগ্র পূর্ব ভারতের শ্রোতাদের হৃদয় দখল করে রাখা কণ্ঠশিল্পী জুবীন গার্গের অকাল প্রয়াণে শোকস্তব্ধ বাংলা সঙ্গীতজগত। আজ ১৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বজ্রাঘাতের মতো সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয় -আকাশে জুবীন গার্গের অকালপ্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর এভাবে চলে যাওয়ার ধাক্কাটা সামলে ওঠা বেশ কষ্টকর। অসমের প্রখ্যাত গায়ক, সুরকার ও অভিনেতা জুবীন গার্গ আজ বাংলা সংগীতপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। অসমিয়া গানের জগৎ থেকে যাত্রা শুরু হলেও ২০০০-এর দশকের শুরুতেই তিনি বাংলা গানের মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করেন। জুবীন গার্গ অসমিয়া সংগীতের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলার চলচ্চিত্র ও আধুনিক গানে যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, তা আজও বিরল।
২০০৩ সালে 'মন' ছবির মাধ্যমে বাংলা সংগীতে তাঁর প্রথম পদার্পণ। তারপর 'শুধু তুমি ' ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা ও প্লেব্যাক—এ যেন বাংলায় তাঁর দৃঢ় উপস্থিতির সূচনা। 'প্রেমী' সিনেমার “ও বন্ধুরে”, “লাগেনা ভালো”, কিংবা চিরদিনই তুমি যে আমার–এর “পিয়া রে পিয়া রে” গান আজও শ্রোতাদের মনে অমর। কিন্তু তাঁর অকাল প্রয়াণে সেই কণ্ঠস্বর চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল।
২০০৬ সালে বলিউডের 'য়া আলি' গান তাঁকে জাতীয় স্তরে জনপ্রিয় করে তোলে। সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে বাংলা গানের জগতেও। ২০০৮ সাল তাঁর কেরিয়ারের জন্য মাইলফলক। একের পর এক বাংলা হিট গান তাঁর সুরে ভেসে আসে। জুবীন এক 'জাতীয় ক্রেজ'এ পরিণত হন।
বাংলা সংগীত সমালোচক সুব্রত দত্ত জানিয়েছেন, “জুবীন গার্গের গান শুধু সুরেলা নয়, আবেগে ভরপুর। তিনি অসমিয়া সুর ও বাংলা মেলোডিকে মিলিয়ে এমন এক ধারা তৈরি করেছিলেন, যা আর কেউ পারেনি। তাঁর চলে যাওয়া বাংলা সঙ্গীতের অপূরণীয় ক্ষতি।”
বাংলাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালক রেজওয়ানুল হকও বলেন, “জুবীন কেবল গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন দুই বাংলার আবেগের সেতুবন্ধন। তাঁর কণ্ঠ আজও লাখো মানুষের স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকবে।”
বাংলা গানের ভুবনে জুবীনের অবদান শুধু শ্রোতাদের কাছে প্রিয় কিছু গান নয়, বরং দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধনের এক সঙ্গীত ভ্রমণ। তাঁর অকাল প্রয়াণে সেই ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে গেল।
জুবীন গার্গ মূলত অসমের গায়ক, সংগীত পরিচালক ও অভিনেতা হলেও বাংলা গানের জগতে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য।
বাংলায় জুবীন গার্গের অবদান:
বাংলা অ্যালবাম ও গানে জনপ্রিয়তা
২০০০ সালের পর থেকে একাধিক বাংলা আধুনিক গান, অ্যালবাম ও সিনেমার প্লেব্যাকে কণ্ঠ দেন। তাঁর কণ্ঠে বাংলা আধুনিক গানের ভিন্ন রকম আবেগ ও সুরভঙ্গি শ্রোতাদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়।
প্লেব্যাক সিঙ্গার
বাংলা সিনেমায়ও তিনি নিয়মিত প্লেব্যাক করেছেন। তাঁর গাওয়া কয়েকটি গান বাংলা সিনেমার চার্টবাস্টার হয় ।উদাহরণস্বরূপ, মন যে করে উরু উরু (চিরদিনই তুমি যে আমার), ভালোবাসি ভালোবাসি, ইত্যাদি গান বহুদিন ধরে শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
সীমান্ত অতিক্রম করা কণ্ঠ
জুবীন গার্গ আসামে যতটা জনপ্রিয়, বাংলা গানেও প্রায় সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছেন। বাংলার শ্রোতারা তাঁর গানে একদিকে অসমিয়া মেলোডির স্বাদ পান, অন্যদিকে আধুনিক বাংলা সংগীতের আবেদনও টের পান।
আঞ্চলিক সংগীতের সেতুবন্ধন
বাংলার সঙ্গে অসমের সংগীত-সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন তিনি। তাঁর কণ্ঠে বাংলা গান শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, বাংলাদেশের শ্রোতাদের মধ্যেও ব্যাপক জনপ্রিয়।
নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা
জুবীন গার্গ নতুন প্রজন্মের অনেক শিল্পীর কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। বাংলা পপ ও ফিউশন ধারায় তাঁর গানগুলোকে অনেক তরুণ শিল্পী রেফারেন্স হিসেবে নেন।
জুবীনের কণ্ঠের বিশেষত্ব হলো আবেগঘন মেলোডি, যেখানে অসমিয়া সুরের ছোঁয়া এবং বাংলা ভাষার মাধুর্য একসাথে মিশে যায়। সমালোচকরা বলেন, এটাই তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। সংগীতশিল্পী অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় যেমন মন্তব্য করেছেন, “জুবীন এখন কেবল অসম বা বাংলার নন, সমগ্র পূর্ব ভারতের এক মেলোডি আইকন।”
প্রায় দীর্ঘ ২০ বছর ধরে বাংলা সিনেমা, অ্যালবাম এবং স্টেজ শো—সব ক্ষেত্রেই তাঁর উপস্থিতি সমানভাবে লক্ষ্যণীয়। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি বাংলা শ্রোতাদের মন জয় করে চলেছিলেন, তিনি প্রমাণ করেছেন ভাষা ও সংস্কৃতির সীমানা অতিক্রম করে সঙ্গীত হতে পারে মিলনের এক সেতুবন্ধন।