৮৫ বসন্ত ছুঁয়েও নতুন চরিত্রের সন্ধান করে চলেছেন জীবনের মঞ্চে এক চিরসবুজ অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

Story by  Debkishor Chakraborty | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 4 d ago
চিরসবুজ অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
চিরসবুজ অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
 
দেবকিশোর চক্রবর্তী 

বাংলা অভিনয় জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আশির কোঠা পেরিয়েও তাঁর চোখের দীপ্তি, কণ্ঠের গভীরতা আর অভিব্যক্তির পরিমিতি আজও দর্শকদের মুগ্ধ করে। জন্ম ১৯৪০ সালের ১৮ অক্টোবর। আট দশকের জীবন পার করেও তিনি যেন প্রমাণ করে চলেছেন—অভিনয় তাঁর কাছে নিছক পেশা নয়, বরং জীবনদর্শনেরই প্রতিফলন।

শৈশব কেটেছে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ পরিবেশে। ছোটবেলা থেকেই নাটকের প্রতি ছিল প্রবল টান। স্কুলজীবনে স্থানীয় মঞ্চে অভিনয় করেই শুরু সেই পথচলা। তবে জীবনের শুরুটা সহজ ছিল না। সংসারের প্রয়োজনে কখনও শিক্ষকতা, কখনও রেডিও নাটকে কণ্ঠদান, আবার কখনও থিয়েটারে অংশগ্রহণ—সব মিলিয়ে এক রঙিন ও পরিশ্রমে ভরা যাত্রা। সেই সংগ্রামের দিনগুলোই তাঁকে পরিণত করেছে আজকের পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ে—একজন শিল্পী, যিনি নিজের শিল্পকে প্রার্থনা মনে করেন।

থিয়েটারের মঞ্চ থেকে বড় পর্দায় আসতে সময় লেগেছিল, কিন্তু একবার আসার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। অভিনয়ের স্বতঃস্ফূর্ততা, সংলাপ বলার স্বরভঙ্গি, মৃদু হাসি ও চোখের চাওয়ায় ফুটে ওঠা আবেগ—সব মিলিয়ে তিনি দ্রুতই দর্শকের মন জয় করেন। সন্দীপ রায় পরিচালিত যেখানে ভূতের ভয় ছবিতে তাড়িনীখুড়ো চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল এক অনন্য মাইলফলক। সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট চরিত্রটি যেন তাঁর মাধ্যমেই জীবন্ত হয়ে ওঠে। আজও সেই রহস্যময় হাসি, সেই দৃষ্টিভঙ্গি দর্শকদের মনে অমলিন।

চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ছোটপর্দাতেও পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সমান জনপ্রিয়। ধারাবাহিক বয়েই গেলো-তে তাঁর রসিক অথচ হৃদয়স্পর্শী চরিত্র দর্শকদের মন ছুঁয়েছিল। আবার জনপ্রিয় কমেডি শো মীরাক্কেল-এর বিচারক হিসেবে তাঁর উপস্থিতি ছিল এক অন্য মাত্রা। প্রতিযোগীদের তিনি যেমন মমতাভরে সমালোচনা করতেন, তেমনি হাস্যরসের আড়ালে পৌঁছে দিতেন জীবনের গভীর শিক্ষা। তাঁর উপস্থিতি মানেই ছিল জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও রসবোধের এক মেলবন্ধন।

অভিনয়ের বাইরে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন নিভৃত, বিনয়ী ও সহানুভূতিশীল মানুষ। সহকর্মীদের কাছে তিনি কখনও ‘সিনিয়র’ হয়ে ওঠেন না; বরং সবার কাছেই একজন অভিভাবক, একজন বন্ধুর মতো। নবীন শিল্পীরা বলেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করা মানেই শেখার সুযোগ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “অভিনয় আমার প্রার্থনা। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই আমি নিজেকে খুঁজে পাই।” কথাগুলোতেই ধরা পড়ে তাঁর শিল্প-দর্শন, জীবনের প্রতি তাঁর নিবেদন।

দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তিনি পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মান। তবে তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার, দর্শকের ভালোবাসা। শহরের রাস্তায়, মেলার মাঠে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায়—যেখানেই তিনি উপস্থিত হন, মানুষের মুখে ফুটে ওঠে এক উষ্ণ হাসি। সেই হাসিই তাঁর প্রকৃত প্রাপ্তি।

পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ে আছে জীবনের গন্ধ। প্রতিটি চরিত্রে তিনি মিশিয়ে দেন নিজের অভিজ্ঞতা ও মানবিকতার ছোঁয়া। কখনও তিনি হাসান, কখনও ভাবান, আবার কখনও নীরবে চোখ ভিজিয়ে দেন দর্শকের। তিনি প্রমাণ করেছেন—একজন অভিনেতার শক্তি কেবল সংলাপে নয়, তাঁর চোখের ভাষায়, তাঁর নীরবতায়ও।

আজকের প্রজন্মের কাছে তিনি এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। তাঁদের চোখে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় মানে এক শিক্ষক, এক দার্শনিক, এক রসিক খুড়ো। তাঁর মধ্যে মিশে আছে জ্ঞানের আলো আর জীবনের মজা। বয়স তাঁকে বেঁধে রাখতে পারেনি। বরং প্রতিটি চরিত্রে তিনি যেন আরও তরুণ, আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন।

বাংলা সিনেমা ও টেলিভিশনের ইতিহাসে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর অভিনয় কেবল বিনোদন নয়—তা এক জীবনবোধের প্রকাশ। তাই বাংলা শিল্পমঞ্চ যতদিন থাকবে, ততদিন থেকে যাবেন তিনি—তাড়িনীখুড়ো হয়ে, শিক্ষক হয়ে, কখনও বা সেই হাসিমাখা খুড়ো হয়ে।

পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু এক অভিনেতা নন, তিনি এক জীবন্ত ইতিহাস। তাঁর প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি দৃষ্টি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—অভিনয় মানেই জীবনের প্রতিচ্ছবি। শিল্পীর বয়স নয়, মনের তারুণ্যই তার আসল শক্তি—এই কথার জীবন্ত প্রমাণ তিনি নিজেই।