‘মেলোডি হাউস’: জুবিন গার্গের অমর সুরে গাঁথা এক স্মৃতিঘর

Story by  Ariful Islam | Posted by  Aparna Das • 7 d ago
'মেলোডি অডিও হাউস'- এ জুবিন গার্গ
'মেলোডি অডিও হাউস'- এ জুবিন গার্গ
 
আরিফুল ইসলাম / গুয়াহাটি 

অসমবাসীর হৃদয়ের অন্তঃস্থল জুড়ে থাকা প্রাণের শিল্পী জুবিন গার্গ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন প্রায় এক মাস আগে। ফিরে আসার কোনো পথ না রেখে চিরবিদায় নিয়েছেন আমাদের সবার প্রিয় সেই শিল্পী। আকাশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে, সাগরের তলায় ঘুমিয়ে পড়া সেই জুবিন চিরতরে হারিয়ে গেছেন আমাদের জীবনের আকাশ থেকে। অভিশপ্ত ১৯ সেপ্টেম্বরের দিনেই সিঙ্গাপুরে চিরনিদ্রায় শায়িত হন সংগীতের দেবতা, 'হার্টথ্রব' জুবিন গার্গ।

অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী ৪০টিরও বেশি ভাষায় ৩৮ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন। সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ১৬ সেপ্টেম্বর, জুবিন গিয়েছিলেন হাতীগাঁওয়ে, এক বিশেষ উদ্দেশ্যে। শিল্পীর নিজস্ব গানগুলির অ্যালবাম নিয়ে গঠিত এক অনন্য সংগ্রহালয় উদ্বোধন করার জন্য।
 
'মেলোডি অডিও হাউস' উদ্বোধন করার একটি মুহূর্ত
 
হাতীগাঁওয়ের শংকর পথের বাসিন্দা ও জুবিন গার্গের একনিষ্ঠ অনুরাগী বিশাল কলিতা সংরক্ষণ করেছিলেন শিল্পীর অনামিকা, মায়া সহ ৩৮ হাজারেরও বেশি গানের অ্যালবাম। প্রায় ২৫ বছর ধরে বিশাল সংগ্রহ করে চলেছিলেন জুবিনের আধুনিক গান, লোকগীতি, বরগীত, ঘোষা, টোকারী গান, হিন্দি গানসহ নানা রকম সৃষ্টিকর্ম। এই বিশাল সংগ্রহের নাম তিনি দিয়েছেন, “Melody House”।
 
আওয়াজ–দ্য ভয়েস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিশাল কলিতা বলেন, “২০১৬ সালে আমি এই সংগ্রহালয়টি তৈরির কথা ভাবি। জুবিন দার অ্যালবাম আমি অনেক আগে থেকেই সংগ্রহ করছি। বেশিরভাগ অ্যালবাম দোকান থেকেই কিনেছি। কিন্তু ২০১২ সালে যখন এই দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেল, তখন আমি অনেক রাজ্যে ঘুরেছি; দিল্লি, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, মুম্বাই, শুধু অ্যালবাম সংগ্রহ করার জন্য। কারণ দাদা অনেক ভাষায় গান গেয়েছিলেন; তেলুগু, বাংলা, এই সব অ্যালবাম অসমে সহজে পাওয়া যেত না।”
 
জুবিন গার্গকে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন বিশাল কলিতা
 
১৯৯৯ সাল থেকেই জুবিন গার্গের অ্যালবাম সংগ্রহ শুরু করেন বিশাল। প্রায় ২৫ বছরের পরিশ্রমে তিনি সেই অ্যালবাম সংগ্রহকে “Melody House” নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহালয়ে রূপ দিতে সক্ষম হন। বিশালের মা বলেন, “ছোটবেলা থেকেই বিশাল জুবিনের অ্যালবাম সংগ্রহ করত। অন্য বাচ্চাদের মতো সে খেলনা চাইত না। বরং সব সময় জুবিনের একটি নতুন অ্যালবাম চাইত। তখন থেকেই সে সংগ্রহ করে আসছে এই অ্যালবামগুলো।”
 
সংগ্রহালয় উদ্বোধনের কয়েক দিন আগে জুবিন নিজে বিশালকে ফোন করে বলেছিলেন কাজ দ্রুত শেষ করতে। তিনি বলেছিলেন, “আমি দীর্ঘদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি, তার আগে সংগ্রহালয়টি উদ্বোধন করে যাব।”
 
জুবিন গার্গের সমস্ত গান সংরক্ষণ করা 'মেলোডি অডিও হাউস'
 
প্রিয় শিল্পীর সেই কথাকে হৃদয়ে ধারণ করে দিনরাত এক করে বিশাল সম্পূর্ণ করেন ‘Melody house’-এর কাজ। উদ্বোধনের দিন বিশালের বাড়িতেই নিজে উপস্থিত হয়েছিলেন জুবিন গার্গ। সেদিন সাধারণ দিনের তুলনায় একটু আগেই তিনি এসে পড়েন। উদ্বোধনের পর প্রশংসায় ভরিয়ে দেন বিশালকে।
 
বিশাল বলেন, “সেদিন দাদার মুখে আনন্দ ফুটে উঠেছিল। সব দেখে তিনি নিজেই নস্টালজিক হয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি এত গান গেয়েছি নাকি!’ দাদা আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিলেন, ‘অসাধারণ কাজ করেছিস। সাধারণত দুই–তিনজন মিলে করে, আর তুই একা করেছিস। খুব ভালো লাগছে। গ্রেট ওয়ার্ক।’ দাদা খুব খুশি হয়েছিলেন।”
 
জুবিন গার্গের সঙ্গে বিশাল কলিতা
 
উল্লেখ্য, জুবিন গার্গ সেই সংগ্রহালয় থেকেই একটি ভিডিও রেকর্ড করে তাঁর অনুরাগীদের পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তিনি সিঙ্গাপুরে যাওয়ার খবর জানান। কেউ ভাবতেও পারেনি, সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করা সেই ভিডিওটাই হবে তাঁর জীবনের শেষ ভিডিও। সেই বেদনাদায়ক খবর প্রকাশের পর থেকেই ‘Melody house’-এ নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া।
 
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশাল কলিতা বলেন, “এই সংগ্রহালয় আমি চিরদিন এভাবেই রাখব। এর সঙ্গে আমার অনুভূতি জড়িয়ে আছে। প্রতিটি অ্যালবাম জোগাড় করতে আমাকে দূরদূরান্তে যেতে হয়েছে। দাদাকে আমি খুব ভালোবাসি। তাঁর স্মৃতিগুলো আমি এভাবেই জীবিত রাখব। ভবিষ্যতে আমি না থাকলেও আমার পরিবার এই সংগ্রহালয় সংরক্ষণ করবে। সারাজীবন আমি একে যত্নে রাখব।”