সাহিত্যের অকৃত্রিম সাধক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 14 d ago
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
 
অপর্ণা দাস / গুয়াহাটি 

আজ আমি কথা বলব বাংলার এক অসাধারণ লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সম্পর্কে। সত্যি বলতে, আমি তাঁর গল্প পড়ে সবসময় মুগ্ধ হই। "ভারতবর্ষ", "রানির ঘাটের বৃত্তান্ত", "মাটি", "দেহমনের স্বাদ " ইত্যাদি আরো অনেক অনেক গল্প দিয়ে চিনেছিলাম মুস্তাফা সিরাজকে। গ্রামের মানুষের জীবন, হাসি-কান্না, সমাজের অসাম্য, সবকিছু তিনি এত সূক্ষ্মভাবে তুলে এনেছেন যে, পাঠক সেটা অনুভব না করে পারবে না। আজ তাঁর জন্মদিন, এবং এই দিনে মনে পড়ে যায় তাঁর লেখা গল্পের সেই অনন্য জাদু।
 
১৯৩০ সালের ১৪ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ও সংগীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মানবজীবনের গভীর অনুধাবনই তাঁকে পরিণত করেছিল এক অনন্য কথাশিল্পীতে।
 
সিরাজের লেখায় বারবার ফিরে এসেছে গ্রামের মানুষের হাসি-কান্না, সমাজের অসাম্য, এবং মানবতার অবিনাশী শক্তি। আমি বিশেষভাবে মনে করি, তাঁর সৃষ্ট “গোগোল” চরিত্র বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় গোয়েন্দাদের মধ্যে একটি-যাকে পাঠকরা আজও ভুলতে পারেননি। বিখ্যাত এই গোয়েন্দা চরিত্র "গোগোল"- এর অনুপ্রেরণা নাকি এসেছিল তাঁর এক কৌতূহলী ছাত্রের কাছ থেকে, যে সব সময় প্রশ্ন করত এবং রহস্যভেদে আগ্রহী ছিল।
 
তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভৌতিক গল্প ধরার এক নীরব অথচ অসাধারণ ক্রাফটসম্যান ( craftsman)। রহস্য, অতিপ্রাকৃত ও বাস্তবতার সূক্ষ্ম মিশেলে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক আলাদা ধাঁচের ভৌতিক সাহিত্য, যা আজও পাঠকদের মনে শিহরণ জাগায়। আসলে তাঁর ভৌতিক গল্পগুলোর মূল ভাবনা-যে ভয়ের গল্পে আসলে ভয় নয়, মানুষের নিজের অন্তরের অন্ধকারই ফুটে ওঠে। বিশেষ করে তাঁর ভৌতিক গল্পগুলো-যে ভয়ের গল্পে আসলে ভয় নয়, মানুষের নিজের অন্তরের অন্ধকারই ফুটে ওঠে।
 
প্রসঙ্গত, বাংলার " হরর কমেডি " ধারার অন্যতম প্রাণপুরুষ তিনিই। তাঁর আগে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ও রাজশেখর বসু (পরশুরাম) এই ধারার কিছু গল্প লিখে গেলেও, বাংলা সাহিত্যের হরর কমেডির শাখায় তাঁর বিরাট অবদান রয়েছে। 
 
সিরাজের ভৌতিক গল্পের বৈশিষ্ট্য ছিল, অলৌকিকতার সঙ্গে মানবমনস্তত্ত্বের গভীর সংযোগ। তাঁর ভূতেরা কেবল ভয় দেখায় না, বরং মানুষকে নিজের ভেতরের অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড় করায়। “চতুরঙ্গ,” “হাড়ের প্রতিশোধ,” “পেত্নীর স্বামী,” “ভূতের রাত,” “বড়বাড়ির শেষ অতিথি” ইত্যাদি গল্পে তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে সমাজ, ভয় ও অপরাধবোধ একত্রে গড়ে তোলে এক ভৌতিক বাস্তবতা।
 
গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ; সবক্ষেত্রেই তাঁর কলমের ছোঁয়ায় ফুটে উঠেছে এক জীবনঘন বাস্তবতা ও সাহিত্যিক সংবেদনশীলতা। ‘আলতাফ হোসেন’, ‘হাজার চুরাশির মা’, ‘তৃতীয় বসন্ত’, ‘অর্ধেক মানুষ’ প্রভৃতি গল্প ও উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের অন্তর্গত যন্ত্রণা ও সংগ্রামকে বিশ্বমানের সাহিত্যিক ভাষায় রূপ দিয়েছেন। তাঁর গল্প ও উপন্যাস অবলম্বনে একাধিক বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বিখ্যাত পরিচালক গৌতম ঘোষ তাঁর “বড় বকুলপুরের যাত্রী” গল্পটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরি করেন।
 
১৯৯৪ সালে তাঁর উপন্যাস "অলীক" এর জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান, যা ছিল তাঁর সাহিত্যজীবনের অন্যতম স্বীকৃতি।
 
আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তাই বলবো যে তিনি শুধুমাত্র একজন সাহিত্যিক নন, তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি মানুষের অন্তরের অনুভূতি, সহানুভূতি এবং মাটির গন্ধকে গল্পের মাধ্যমে জীবনদান করেছেন।


শেহতীয়া খবৰ