ড. রেজভি সুলতানা
মুন্নী বেগম , গুয়াহাটি
সংস্কৃত শুধুমাত্র কোনো এক নির্দিষ্ট ধর্মের ভাষা নয় এই কথাটিকে বাস্তবে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন একজন মুসলিম মহিলা ড. রেজভি সুলতানা। ধর্মীয় বিভাজনকে একদিকে সরিয়ে রেখে তিনি নিজের আগ্রহ ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী সংস্কৃত ভাষায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং সমাজে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে চলেছেন।বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মেঘালয়ের (USTM) অধীনে থাকা একটি আয়ুর্বেদিক মহাবিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষাদান করছেন।
‘আওয়াজ দ্য ভয়েস’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ড. রেজভি সুলতানা বলেন,"আমি অষ্টম শ্রেণিতে যখন চতুর্থ বিষয় হিসেবে সংস্কৃত পড়া শুরু করি, তখন থেকেই এই বিষয়ের প্রতি আমার এক বিশেষ আকর্ষণ গড়ে ওঠে। এই বিষয়টি নেওয়ার জন্য পরিবার বা সমাজের পক্ষ থেকে কোনো বাধা পাইনি।"তিনি জানান,তিনি নগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে সংস্কৃতে লেটার মার্কসহ রাজ্যে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন। এরপর কটন কলেজে ভর্তি হয়ে উচ্চমাধ্যমিকে সংস্কৃতে রাজ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর লাভ করেন। এরপর তিনি সংস্কৃত বিষয়ে অনার্স নিয়ে স্নাতক পাশ করেন।
ড. রেজভি সুলতানা
তিনি বলেন,"আমি পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হিন্দু কলেজ থেকে ২০০৬ সালে এমএ করি এবং গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে এম.ফিল এবং ২০১৭ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করি। তাই আমি বিশ্বাস করি, সকলের সংস্কৃত পড়া উচিত, কারণ এই ভাষায় জানার মতো অনেক কিছু রয়েছে।”বর্তমানে সমাজের একাংশ সংস্কৃত ভাষাকে ‘মৃত ভাষা’ বলে গণ্য করলেও, বাস্তবে এটি একটি দার্শনিক,গভীর এবং জটিল ভাষা, যা বহু প্রাচীন জ্ঞান ও ভাবনার বাহক।
ড. রেজভি সুলতানার কথা “সংস্কৃত কোনো মৃত ভাষা নয়”। ড. রেজভি সুলতানা জানান,“আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সংস্কৃত ভাষাটি ব্যবহার করি না, কারণ এটিকে মৃত ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃত একেবারেই মৃত ভাষা নয়। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে বেদ, উপনিষদ সহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থেই সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার হয়ে আসছে। বর্তমানে CBSE এবং SEBA-র অধীনে থাকা সমস্ত বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য সংস্কৃত বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,“সংস্কৃত হলো দেবভাষা, আর সব ভাষার মূল শিকড় হল এই সংস্কৃত। সংস্কৃত অধ্যয়ন করলে আমাদের ভাষা আরও বিশুদ্ধ হয়। কিন্তু আজকের প্রজন্মের মধ্যে সংস্কৃত ভাষা পড়ার আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে। সাধারণত সংস্কৃতকে একটি কঠিন ভাষা হিসেবে ধরা হয়, যেটি শুধুমাত্র বেদ ও উপনিষদের কঠিন শ্লোকসমূহেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করা হয়। ফলে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী নম্বর পাওয়ার জন্যই কেবল সংস্কৃত পড়ে।”
ড. রেজভি সুলতানা বলেন,“আজকাল দেখা যায় ছাত্রছাত্রীরা একপর্যায়ে সংস্কৃত পড়ে, কিন্তু পরে সেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারণ সংস্কৃতকে গণিতের মতো মনে করা হয় শ্লোক মুখস্থ রাখলেই নম্বর পাওয়া যায়। এজন্য এই বিষয়কে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য আমি তাদের শ্লোক পাঠ করাই, পঞ্চতন্ত্রের নীতিকথা শেখাই এবং প্রতিদিনের জীবনে প্রাসঙ্গিক কিছু কাজও তাদের দিয়ে থাকি।”
ড. রেজভি সুলতানা ভবিষ্যতে সংস্কৃত বিষয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশের পরিকল্পনা করছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন,“বর্তমানে চারদিকে ধর্মের নামে নানা বিভেদমূলক কথা বার্তা শোনা যায়। কিন্তু আমি কোরআন ও বেদ দুইই পড়েছি এবং কোথাও কখনো অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানোর কথা লেখা নেই। আমি কোরআন পড়ি এবং বেদও অধ্যয়ন করেছি। যতটুকু জেনেছি, সেখানে কোনো বিরোধ দেখি না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যাঁদের ‘ভগবান’ বলেন, আমরা তাঁদের ‘আল্লাহ’ নামে ডাকি – দুজনেই একজন সর্বশক্তিমান সত্তার প্রতি বিশ্বাস রাখি।”
তিনি বলেন,“হিন্দুরা ঈশ্বরকে নানা রূপে পূজা করেন। প্রতিটি ধর্মেই একজন ধর্মপ্রচারক আছেন,যাঁরা বলেছে গেছেন, নিজের ধর্মের মতোই অন্য ধর্মকেও সম্মান করা উচিত।”