কেমব্রিজের বাঙালি গবেষক মতিয়ার রহমানের গবেষণার ফসল কৃত্রিম পাতা, সৌর শক্তি থেকে মিলবে তরল জ্বালানি

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 5 d ago
কেমব্রিজের বাঙালি গবেষক মতিয়ার রহমান
কেমব্রিজের বাঙালি গবেষক মতিয়ার রহমান
 
দেব কিশোর চক্রবর্তী / কলকাতা 

সাম্প্রতিক বিশ্বে মানব সভ্যতা এখন দাঁড়িয়ে আছে এক চরম হুমকির মুখে। সংকটে প্রকৃতি, বাতাসে বাড়ছে বিষ। বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। তামাম বিশ্বজুড়ে লাগামহীন ভাবে বাড়ছে উষ্ণায়ন। প্রকৃতির ঋতুচক্রও পাল্টে যাচ্ছে। ক্রমশ দীর্ঘায়িত হচ্ছে গ্রীষ্ম। অন্যদিকে,  হিমবাহ গলতে শুরু করেছে। পৃথিবীর বুকে শুকিয়ে যাচ্ছে ঘাস। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। পৃথিবীতে ঘনিয়ে আসছে বিপদ। আর এই বিপদের হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জকে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে এর মোকাবেলায় একের পর এক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীকে বাঁচানোর যুদ্ধে, এবং নতুন আলোর সন্ধানে অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দেশ বিদেশের পরিবেশবিদরা ও বিজ্ঞানীরা। এমনই এক পথের সন্ধানে নেমেছেন এক বাঙালি গবেষক মতিয়ার রহমান।

তিনি তাঁর নিয়ত চেষ্টা ও গবেষণার ফল পেলেন হাতে নাতে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিনিয়র সায়েন্টিস্ট মতিয়ার রহমান এবং তাঁর সহকর্মী বিজ্ঞানী শুভজিৎ ভট্টাচার্য বানিয়ে ফেললেন কৃত্রিম পাতা (Artificial Leaf)। যা সূর্যালোক, জল আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে তৈরি করবে তরল জ্বালানি আর অক্সিজেন। তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত নেচার জার্নালের (Nature Journal) সাব-জার্নাল নেচার এনার্জি-তে (Nature Energy)।
 
বৈজ্ঞানিক গবেষণাকালীন মতিয়ার রহমানের একটি ছবি 
 
বর্ধমান জেলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ জনপদ কালনার কদম্বা গ্রামের বাসিন্দা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী মতিয়ার জানাচ্ছেন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সেন্ট জনস কলেজের ফেলো এরউইন রেইসনারের নেতৃত্বে ‘রেইসনার ল্যাব’-এ তিনি এবং তাঁর সহকর্মী এই গবেষণা করেছেন। সংবাদ মাধ্যমে তিনি জানান, “কার্বন-ডাই-অক্সাইড কিন্তু পৃথিবীর জন্য খুব জরুরি। গাছের সালোকসংশ্লেষণ এই গ্যাস ছাড়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে, অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড কিন্তু পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই গ্রিন হাউস গ্যাসটিই বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ।” 
 
তিনি আরও বলেন, “আমাদের সামনে উষ্ণায়ন একমাত্র সমস্যা নয়। আজকের বিশ্ব দাঁড়িয়ে আছে তুমুল জ্বালানি সংকটের সামনে। অথচ আমরা এখনও জীবাশ্ম জ্বালানির উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। কিন্তু এই ধরনের জ্বালানির পরিমাণ ক্রমশ সীমিত হয়ে আসছে। আমরা চেষ্টা করেছি দুটি সমস্যার উত্তর একসঙ্গে দিতে।”
 
অম্বিকা কালনার মহারাজা উচ্চ-বিদ্যালয়ের পর যাদবপুর থেকে রসায়নে স্নাতক হন মতিয়ার। তারপর মাদ্রাজ আইআইটি থেকে এমএসসি করেন। এরপর সুইৎজ়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ বার্ন থেকে পিএইচডি করেন। তারপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টরেট গবেষণায় যোগ দেন ‘মারি কুরি ফেলো’ হয়ে। এখন সেখানেই সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হয়ে কর্মরত আছেন মতিয়ার। তিনি বলছেন, ‘‘উষ্ণায়নের জন্য অন্যতম দায়ী যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, তাকে অন্য কোনও উপাদানে রূপান্তরিত করতে প্রচুর শক্তির দরকার হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কেবল সৌরশক্তির সাহায্যেই তা করা যাবে।’’
 
গবেষক পদার্থের একটি ছবি 
 
এখন বাতাসে রোজ বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ আর কমছে জীবাশ্ম জ্বালানি (Fossil Fuel)। সাম্প্রতিক সময়ে বাতাসে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪২৪ পিপিএম কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশছে। জীবাশ্ম জ্বালানির  ব্যবহারের ফলে যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এ প্রসঙ্গে মতিয়ার রহমান বলেন, “বাতাসের অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমানো না গেলে ঠেকানো যাবে না উষ্ণায়ন। তাই আমরা এমন একটা সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছি, যাতে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্পও পাওয়া যায়, আর তা পরিবেশে নতুন করে কার্বন নির্গমনও না করে।” 
 
কিন্তু প্রশ্ন হল, জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প পাওয়া তথা বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমানো কী করে সম্ভব? এ প্রসঙ্গে গবেষক মতিয়ার রহমানের উত্তর, “আমরা যদি কার্বন-ডাই-অক্সাইডকেই জ্বালানিতে বদলে ফেলতে পারি, তা হলে আমাদের দুটো লক্ষ্যই একসঙ্গে পূরণ করা সম্ভব।” কিন্তু আমরা জানি কার্বন-যুক্ত যে কোনও যৌগকে জ্বালালে তার থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে যে জ্বালানি তৈরি করা হল, তাতে নিঃসন্দেহে কার্বন যৌগটি থাকবে। সেই জ্বালানি পোড়ালে তো ফের আবার বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডই ফেরত যাবে।
 
এর কী সমাধান? এ প্রসঙ্গে তঁর উত্তর, “আমাদের যন্ত্রটির মাধ্যমে কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে তৈরি হয় ইথানল, প্রোপানল প্রভৃতি জ্বালানি আর অক্সিজেন। জ্বালানিগুলি সহজেই বহনযোগ্য। ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন শিল্পে, গাড়ির ইঞ্জিনে। আর এই জ্বালানিগুলি যেহেতু বাতাসের অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করেই তৈরি হচ্ছে, তাই গোটা প্রক্রিয়ায় বাতাসে মোট কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ হচ্ছে শূন্য (Net Zero)। এই ধরনের পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি (Renewable Fuel) গুলিই অদূর ভবিষ্যতে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে, এমনটাই দাবি মতিয়ার রহমানের।
 
ক্যামব্রিজের গবেষকদের সঙ্গে মতিয়ার রহমানের একটি ছবি 
 
এখন প্রশ্ন হল, এই অভিনব যন্ত্রটির নাম কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে? এ বিষয়ে তিনি বলেন, "এটি এমন একটি যন্ত্র যাকে আমরা কৃত্রিম পাতা বলছি। গাছ যেমন সূর্যালোক, জল আর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সহযোগে তৈরি করে শর্করা এবং অক্সিজেন, এই যন্ত্রটিও তেমনই সূর্যালোক, আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত জল থেকে তৈরি করে জ্বালানি আর অক্সিজেন। যেহেতু আমরা সূর্যালোক ব্যবহার করেছি, তাই জ্বালানি উৎপাদনের প্রক্রিয়ার খরচও অপেক্ষাকৃত কম। আর এই কৃত্রিম পাতাটির দুটি অংশ। এক প্রান্তে থাকে একটি সৌরকোষ (Solar Cell) ও একটি দ্বিধাতব অনুঘটক। সৌরকোষের মাধ্যমে সৌরশক্তি শোষণ করা হয়। সেই শক্তির সাহায্যে, অনুঘটকটির মাধ্যমে, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বিজারণ ঘটিয়ে তৈরি হয় ইথানল, প্রোপানল প্রভৃতি জ্বালানি। যন্ত্রটির অন্য প্রান্তে থাকা একটি ন্যানোমেটেরিয়াল জলের জারণ ঘটিয়ে তৈরি করে অক্সিজেন। এই দুটি প্রক্রিয়া ঘটাতে হয় একসঙ্গে, যাতে পুরো প্রক্রিয়াটি সার্বিক ভাবে ইলেকট্রোনিউট্রাল থাকে।  কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত জলে যন্ত্রটি রেখে সেটিকে সূর্যালোকে রেখে দিলেই যন্ত্রটি কাজ করতে শুরু করে।
 
মতিয়ার রহমান আওয়াজ দ্যা ভয়েস'কে জানান, “সারা পৃথিবী জুড়েই পরিবেশের অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমানোর চেষ্টা চলছে। চেষ্টা চলছে এই গ্রিন হাউস গ্যাসটি থেকে জ্বালানি তৈরি করার। সাফল্যও পাওয়া গেছে অনেকক্ষেত্রে। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে জ্বালানি তৈরি করার জন্য দরকার হয় প্রচুর পরিমাণ শক্তি, যা মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকেই আসে। কিন্তু আমরা সরাসরি সালোকসংশ্লেষণের পদ্ধতি অনুকরণ করে সূর্যালোক ব্যবহার করে, কৃত্রিম পাতার সাহায্যে, মাল্টি-কার্বন তরল জ্বালানি তৈরি করতে পেরেছি। এই ঘটনা বিশ্বে এই প্রথম। তাই আমাদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশ পেয়েছে নেচারের মতো বিখ্যাত জার্নালে।” 
 
গবেষক মতিয়ার রহমান
 
তিনি এই গবেষণাত্রটির প্রথম প্রণেতা (First Author)। গবেষণাপত্রটির মুখ্য প্রণেতা হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সেন্ট জনসের ফেলো এরউইন রেইসনার। এই গবেষণাটি করা হয়েছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেইসনার গবেষণাগারে (Reisner Laboratory)।
 
গ্রামবাংলার সাধারণ স্কুল থেকে পড়াশোনা করে, বিশ্বের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ এমন এক গবেষণায় শামিল হতে পারাটা অবশ্যই একটি দৃষ্টান্ত। আর সেই নজির স্থাপন করে তৃপ্ত মতিয়ারও। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা, প্রতিটি ধাপেই নিজেকে ভাল ভাবে তৈরি করতে হবে। ধাপে ধাপে এগিয়ে গেলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।’’