দেবকিশোর চক্রবর্তী
পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস প্রসিদ্ধ মুর্শিদাবাদ জেলার এক অনালোকিত প্রান্তিক জনপদ অরঙ্গাবাদ। ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের একদা পিছিয়ে থাকা এই জনপদের উন্মুক্ত আঁচল ঢেকেছে এক অচেনা অজ গ্রামকে। অন্ধকারে ডুবে থাকা ভারত ভূখণ্ডের সেই গ্রামের নাম চাঁদরা। একদা সন্ধ্যা নামলেই যেখানে খেলা করতো রাত জাগা জোনাকিরা। এমন একটি অজ পাড়া গ্রামের নাম স্বাভাবিকভাবেই সকলের অজানা। তেমই একটি গ্রামকে রোশনির আলোয় আলোকিত করেছেন যিনি তার নাম মোস্তাক হোসেন। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম এই শিল্প উদ্যোগী ও শিক্ষা প্রেমীকে আজ দেশের অনেক মানুষই চেনেন।
তারই বদান্যতায় এই গ্রামটি আজ ভারত মানচিত্রে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। আর এই চাঁদরা গ্রামেরই ভূমিপুত্র মোস্তাক হোসেন হঠাৎ করে এত প্রচার এবং প্রসার কিভাবে পেলেন? প্রশ্ন তো উঠবেই। কীভাবে তাঁর বেড়ে ওঠা এবং কেমন ছিল তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য? সেই সব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে এই প্রতিবেদন।
সামাজিক কর্মব্যস্ততার মধ্যে মোস্তাক হোসেন
পূবের পদ্মা আর পশ্চিমের গঙ্গা, দুই নদীর সর্বনাশা ভাঙন প্লাবনে নিত্য সংশয়ে থাকেন অরঙ্গাবাদের মানুষ। এই অঞ্চলের ৯০% মানুষ আজও দারিদ্র সীমার নিচে বাস করেন। আর এখানকার বেশিরভাগ মানুষেরই জীবন জীবিকা কৃষিকাজ। গত শতকের সাতের দশকে এখানকার মানুষ ভৌগোলিকভাবে এক অভিনব সমস্যার মুখে পড়ে। ভারত ভাগের সময় কারো জমি জায়গা গেল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আর বসতবাটি রইল এ দেশে। এমনই এক বিচিত্র ও দরিদ্র গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন আজকের পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট শিল্পপতি মোস্তাক হোসেন। সাত পুরুষের পরম্পরায় তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল যথেষ্ট উজ্জ্বল এবং স্বচ্ছল। কে জানতো চাঁদরা গ্রামের এই অখ্যাত শিশু পুত্রটিই একদিন সারা বাংলার মুসলিম সমাজের আলোর দিশারী হয়ে উঠবেন।
পশ্চিমবঙ্গের যে কজন সফল শিল্পপতি রয়েছেন তাদের মধ্যে সর্বজনবিদিত এক ব্যতিক্রমী নাম মোস্তাক হোসেন। বিশেষ করে বাংলার প্রান্তিক মুসলিম সমাজের কাছে তিনি নতুন আলোর দিশারী। মানবতাবাদী মোস্তাক হোসেন ভীষণভাবে সমাজ দরদী এবং শিক্ষাব্রতী একজন মানুষ। একই সঙ্গে তিনি যে একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ সে কথাও জেনেছেন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা।
একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে মোস্তাক হোসেন
তাঁর মত একজন সফল শিল্পপতি ঠিক কী কারণে মুসলিম ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রতি এত উৎসাহী হলেন ? কেন তিনি বাংলার গ্রামে গ্রামে, জেলায় জেলায় বিভিন্ন মিশনগুলিকে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছেন? কেনই বা তিনি,পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেক গ্রামে গড়ে ওঠা এইসব মিশন স্কুলগুলিকে অকাতরে অর্থ সাহায্য করছেন? এমন অজস্র প্রশ্ন রয়েছে অনেকরই মনে। এপার বাংলার এই ব্যতিক্রমী শিল্পপতি কৌতুহলীদের সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নিজেই।
আওয়াজ দ্যা ভয়েসকে মোস্তাক হোসেন বলেন, "পশ্চিম বঙ্গের বেকার যুবক যুবতীদের একটা বৃহৎ অংশের প্রতি বছরের পর বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চলা সামাজিক বঞ্চনা আমাকে ভীষণ ভাবিয়েছে। যুব সম্প্রদায়ের নিত্য দিনের হতাশা, দুর্ভোগ ও অনিশ্চিত জীবন যাপন আমি উপলব্ধি করেছি অন্তর দিয়ে। কর্মহীন বেকার যুবক-যুবতীদের কান্না আমাকে বেদনাহত করেছে।"
একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে মোস্তাক হোসেন
হাজার হাজার বেকার যুবক যুবতীদের কর্মসংস্থান কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়। আরও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি দারিদ্র অনগ্রসরতার একমাত্র কারণ নয়। হয়ত বা ক্ষুদ্র উপসর্গ। ধারাবাহিক, বংশপরম্পরাগত অনীহাই শিক্ষাহীনতা এবং এইভাবে যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে থাকার, পিছিয়ে পড়ার প্রধান উৎস। সাহস ও সদিচ্ছার অভাবও বহু কারণের একটি।
ধর্মের সহিষ্ণু মনোভাব, তার শিক্ষা-দৃষ্টি, বিদ্যার প্রচার ও প্রসারের ঐতিহ্য, মহানবীর আদর্শ, পবিত্র মহাগ্রন্থ কোরাণের নির্বাচিত অনুষঙ্গ এবং উন্নততর প্রতিবেশী সমাজের বিদ্যানুরাগের উদাহরণ দেখিয়ে সমাজের ভেতর ও বাইরে, অতি অবশ্যই গড়া যেত, আজও গড়া যায় বিদ্যাপ্রীতির সম্মিলিত মঞ্চ। না হলে যে এখনও অন্ধকারে, সে আঁধার নিয়েই পড়ে থাকবে। আলোর যে বাসিন্দা তাকে পেছন দিকে টানবে, টানতে থাকবে।
নুরুল আমিন বিশ্বাস রচিত 'মোস্তাক হোসেন' নামক বইয়ের প্রচ্ছদের একটি চিত্র
তিনি আরো বলেন, সমাজের স্ব-উদ্যোগে নির্মিত আবাসিক স্কুলগুলি আমাদের স্বপ্ন, আমাদের যৌথ আন্দোলন। শুধু শিক্ষার জন্য নয়, বিদ্যা প্রসারের জন্যও নয়, আমাদের আরেক লক্ষ্য নৈতিকতাময় সমাজ সেবা।
ইসলাম নির্বিশেষের জন্য যে শিক্ষা নীতি বাতলে দিয়েছে, বিদ্যাকে সর্বমুখী করার জন্য যে ইস্তাহার প্রচার করেছে, বিদ্বান ও বিজ্ঞ ব্যক্তিকে তার প্রতিবেশী, তার সম্প্রদায়, তার জাতি এবং অভিন্ন মানুষের পাশে সংশয়হীন চিত্তে দাঁড়াবার যে পরামর্শ দিয়েছে, নিরন্ন এবং দুঃস্থকে কোলে তুলে, সযত্নে তার দেহ ও চিত্ত নির্মাণের যে ফরমান জারি করেছে, আমরা সীমিত সম্বল ও কর্মশক্তি নিয়ে সে সব আদর্শের চারা পুঁতে রাখতে চাই প্রায় অর্ধশতাধিক আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আমাদের সাফল্য পূর্ণাঙ্গ নয়, এখনও আংশিক।