বাংলার মুসলিম সমাজে শিক্ষার নতুন দিশা আল-আমীন মিশন

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 4 h ago
আল- আমীন মিশনের  প্রতিষ্ঠাতা, মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম
আল- আমীন মিশনের প্রতিষ্ঠাতা, মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম
 
সুদীপ শর্মা চৌধুরী, গুয়াহাটি 

১৯৪৭ সাল ছিল ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। আড়াই শতাধিক বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে অবিভক্ত ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে। তবে একইসঙ্গে দেশের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্ত বিভক্ত হয়ে যায় ভারতের মানচিত্র থেকে। এই বিভাজনের ফলে মুসলমান সমাজের একটা বৃহৎ অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে থেকে গিয়েছিলেন। দশকের পর দশক ধরে এই সম্প্রদায়টি স্থবির অবস্থায় ছিল। তবে গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয়। আর পরিবর্তন আসে আল-আমীন মিশনের হাত ধরে। 

পিছিয়ে থাকা মুসলমান সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আত্মপ্রকাশ ঘটে বেশ কিছু মিশনের। আল-আমীন মিশনের যাত্রা শুরু প্রায় তিন দশক আগে। পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত এলাকায়, মুহাম্মদ নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি সাহসী দল সর্বস্তরে শিক্ষা বিস্তারের আপাত কঠিন পথটি বেছে নেয়। একেবারে প্রতিকূল স্রোত, যেখানে আগে কেউ হাঁটেনি। 
 

আল- আমীন মিশনের  প্রতিষ্ঠাতা, মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম
 
তাদের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট বছরের পর বছর ধরে পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে শক্তিশালী, আত্মবিশ্বাসী ও শিক্ষিত সমাজে রূপান্তর করা। এই মিশনের লক্ষ্য শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগতমান এবং উৎকর্ষতা অর্জন করা। পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত মেধাবী শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিকভাবে সহায়তা প্রদান করা। ন্যায্যতা, সমতা, সাম্য ও স্বচ্ছতার নীতিমালা অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়া।
 
আল-আমীন মিশনের কাণ্ডারী এম নুরুল ইসলাম আজও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, "সমাজ পরিবর্তনের একমাত্র উপায় হল শিক্ষা।" এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নেয় 'আল-আমীন মিশন'। এটি শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি একটি আন্দোলন।
 
এই যাত্রা পথ কখনোই সহজ ছিল না। মিশনকে পার হতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং সামাজিক বাধা। তবুও, তারা নানা প্রতিকূলতায় তাদের নীতিতে অটল থেকেছে, মাথা নত করেনি।
 
আল আমীন মিশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠান
 
পশ্চিম বাংলার সেই ছোট্ট খালতপুর গ্রামের মাটিতে রোপিত বীজ আজ এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে আল-আমীন মিশনের অধীনে ৬৭টি প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে ৪১টি আবাসিক ক্যাম্পাস, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ঝাড়খণ্ডে বিস্তৃত এবং এতে ১২,০০০-এর বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
 
এরই মধ্যে ২০,০০০-এর বেশি শিক্ষার্থী এই মিশনের কঠোর পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করে সমাজে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে, কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক, কেউ প্রশাসক  প্রত্যেকেই সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে।
 
মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম তিনি "বাংলার স্যার  সৈয়দ" নামেও সুপরিচিত । তিনি ১৯৮৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম খালাতপুরে মাত্র ৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আল-আমীন মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে এই শিক্ষামূলক উদ্যোগটি আজ একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
 
মিশনের ছাত্রদের সঙ্গে নুরুল ইসলাম
 
বর্তমানে মিশনের অধীনে রয়েছে ৭২ টি প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে ৪১টি আবাসিক ক্যাম্পাস। দেশের পাঁচটি রাজ্যে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন শাখা প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে ২০,০০০-এরও বেশি শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করছে।এই প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য সাফল্য হল প্রায় ৮,০০০ জন ডাক্তার, প্রায় ৫,২৫০ জন ইঞ্জিনিয়ার এখান থেকে তৈরি হয়েছে। যাদের অধিকাংশই দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবার থেকে উঠে আসা।
 
আল আমীন মিশনের মূল লক্ষ্য মূল লক্ষ্য হলো, "দরিদ্র ও পশ্চাদপদ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করা এবং সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা।" মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম, যিনি 'বাংলার স্যার  সৈয়দ' নামে পরিচিত। তিনি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার খালতপুর গ্রামে ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৭ সালে 'আল-আমীন মিশন' প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ৭২টি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। এই মিশনটি ২০,০০০-এরও বেশি ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষা প্রদান করছে।
 
মিশনের কর্মব্যস্ততার মাঝে নুরুল ইসলাম
 
আল-আমীন প্রসঙ্গে সংস্থার কর্ণধার নুরুল ইসলাম  আওয়াজ দ্যা ভয়েজকে জানান, "আল-আমীন মিশন একদিন তার কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল বাংলার পশ্চাদপদ সমাজকে। পিছিয়েপড়া শ্রেণির এতিম শিশুরা আরও পিছিয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। দৈনন্দিন জীবনধারণই যেখানে প্রবল সমস্যা, লেখাপড়া সেখানে তো স্বপ্নলোকে বিচরণের মতো। সেখানে পৌঁছোবে কী করে এতিমরা? শুরুর দিন থেকে তাই আল-আমীন মিশন এতিম শিশুদের বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে আসছে।অভিজ্ঞতা থেকে তাই আল-আমীন শিখেছে স্বপ্ন কেমন করে পূরণ করতে হয়।"
 
শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু করেন মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালে মাত্র দশম শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় খালতপুর জুনিয়র হাই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৪ সালে 'ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক কালচার'প্রতিষ্ঠার পর, ১৯৮৭ সালে এটি 'আল-আমীন মিশন' নামে পুনঃনামকরণ করা হয়। তিনি মিশনের মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষা ও ইসলামী মূল্যবোধের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। অর্জন ও সাফল্য হিসাবে আল-আমীন মিশন ৩,৫০০-এরও বেশি চিকিৎসক (এম বি বি এস ও বি ডি এস), ৩,০০০ ইঞ্জিনিয়ার, এবং অসংখ্য শিক্ষক, গবেষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা তৈরি করেছেন। ২০১৮ সালে, ৩৭০ জন শিক্ষার্থী NEET পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, যার মধ্যে ৩১৯ জন সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন ।
 
মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম একটি বই উন্মোচন করছেন
 
পুরস্কার ও স্বীকৃতি:
 
মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম ২০২১ সালে 'মায়শাত বেস্ট এডুপ্রেনিউর অ্যাওয়ার্ড' লাভ করেন। তিনি 'বঙ্গভূষণ' (২০১৫), 'দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স' (২০০২ ও ২০০৯), এবং 'বেগম রোকেয়া পুরস্কার' (২০১০) সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।