ফারহাদ ইজরাইলি
আলিগড়ের জামে মসজিদ শুধুমাত্র একটি প্রাচীন ধর্মীয় নিদর্শন নয়, এটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গৌরবময় স্মারক। শতাব্দী পেরিয়ে আজও এই মসজিদের প্রাচীর ও গম্বুজ আমাদের অতীতের বীরত্ব ও ত্যাগের কথা বলছে। এখানকার প্রতিটি ইট যেন স্বাধীনতার জন্য শহীদ হওয়া সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথা ছড়িয়ে দেয়।
এই মসজিদের প্রাঙ্গণে, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ হওয়া ৭৩ জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে। যা এই মসজিদটিকে এক অনন্য ও পবিত্র স্মৃতিস্হল হিসেবে গড়ে তুলেছে।
১৮৫৭ সালের বিপ্লব ও জামে মসজিদের ভূমিকা
১৮৫৭ সালের ১০ মে থেকে ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত চলা এই আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম সংগঠিত বিদ্রোহ। ব্রিটিশরা এটিকে বিদ্রোহ বলে ডাকে, তবে ভারতের ইতিহাসে এটি স্বাধীনতার প্রথম আগুন।
আলিগড় শাহী জামে মসজিদের একটি সমাধি
এই বিপ্লবের সময় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। মুসলমানরাও এই বিপ্লবের অগ্রভাগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন। আলিগড়ের জামে মসজিদ তার এক ঐতিহাসিক উদাহরণ।
মাওলানা আব্দুল জলিল ইজরাইলি শহীদ
আলিগড়ের এই মসজিদের ইমাম, মাওলানা আব্দুল জলিল ইজরাইলি ছিলেন শুধুমাত্র ধর্মীয় নেতা নন, তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা করে তার সহযোগী ও ছাত্রদের নিয়ে ময়দান-এ-জং (যুদ্ধক্ষেত্র)-এ অংশগ্রহণ করেছিলেন। অবশেষে তিনি শহীদ হন। মাওলানা আব্দুল জলিল ও তার সহযোগীদের সমাধি এই মসজিদের প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়।
এই শহীদদের গুরুত্ব শুধুমাত্র স্থানীয় নয়, জাতীয় পর্যায়েও যথেষ্ট মর্যাদা পেয়েছে। বিশিষ্ট পণ্ডিত ও পদ্মশ্রী প্রাপ্ত অধ্যাপক জিলুর রহমান মাওলানা আব্দুল জলিল ইজরাইলির শহীদ হওয়ার কথা স্মরণ করে বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাছিম নানৌতভীর স্বপ্নে এই সংকেত দিয়েছিলেন, “আমার বন্ধু আলিগড়ে শহীদ হয়েছে, যাক নিয়ে যাওয়া হোক এবং তার সন্তানদের শিক্ষা প্রদান করা হোক।”
মসজিদের উত্তর অংশে অবস্থিত কবরস্থান, যেখানে মসজিদের ইমাম মাওলানা জলিলের নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিহত ৭৩ জন শহীদকে সমাহিত করা হয়েছিল।
শিক্ষার উত্তরাধিকার ও নানৌতভীর অবদান
এই স্বপ্নের প্রভাবে মাওলানা কাছিম নানৌতভী আলিগড়ে আসেন এবং শহীদ মাওলানা আব্দুল জলিলের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি শিক্ষাদানের প্রস্তাব দেন, তবে পরিবারটি অক্ষমতা প্রকাশ করে জানায় যে তারা মাশুল আদায় দিতে পারবে না।
এরপর মাওলানা নানৌতভী বলেন, “আমাদের কঠোর পরিশ্রমের জন্য মাশুলের প্রয়োজন নেই, আমি এখানে রাসূলের (সা:) আদেশ পালন করতে এসেছি। আমাদের শিক্ষাদানের জন্য কিছু স্থান দাও।” এরপর তিনি ওই পরিবারের অন্যান্য শিশুকেও পড়াতে শুরু করেন, যাহাতে একটি নতুন শিক্ষামূলক পথের সূচনা ঘটে।
৭৩ জন শহীদ, একটি মসজিদ ও এক ঐতিহ্য
ইতিহাসবিদদের মতে, পৃথিবীর অন্য কোনো মসজিদে ৭৩ জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থল নেই। এটি শুধুমাত্র একটি জামে মসজিদ নয়, এটি একটি শহীদ ময়দানও। আমাদের এই ভূমি সেইসব সন্তানদের বলিদান স্মরণে অটুট থাকে, যারা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল।
আলিগড় শাহী জামে মসজিদের ভিতরের অংশ
মাওলানা আব্দুল জলিল ইজরাইলির নাতি ইঞ্জিনিয়ার রাহাত সুলতান ইজরাইলি বলেন, আজ তার পঞ্চম প্রজন্ম সক্রিয়ভাবে পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার রক্ষা করে দেশসেবায় নিয়োজিত। শহীদ হওয়ার পরেও আমাদের পূর্বপুরুষেরা সাহস হারাননি, বরং দেশের সেবা ও শিক্ষার অগ্রযাত্রায় এগিয়ে গিয়েছেন।
সেই বলিদানকে শ্রদ্ধা
জামে মসজিদের সমাধিস্থল শুধুমাত্র সাধারণ সমাধিস্থল নয়, এটি শহীদদের অন্তরাত্মার বিশ্রাম স্থান, যা সকল বয়সের মানুষকে স্বাধীনতা, ত্যাগ ও আত্মসম্মান শেখায়। এই মসজিদটি শুধু আলিগড়ের পরিচয় নয়, এটি ভারতের স্বাধীনতার অন্যতম সাক্ষী, যেখানে দেয়াল ও গম্বুজ উভয়ই গৌরবে স্বাধীনতার গল্প বলে যায়।