শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
আসামের মাটিতে জন্ম হলেও ভূপেন হাজারিকার শিল্পীজীবনের বিকাশ ও সর্বভারতীয় পরিচিতির মঞ্চ ছিল কলকাতা। এই শহর তাঁর গান, সুর, সিনেমা ও সমাজচিন্তার পরিসরকে বহুগুণ প্রসারিত করে।
১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে ছাত্রজীবনের সূত্রে তিনি প্রথম কলকাতায় আসেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনার সময়েই শহরের সাংস্কৃতিক আবহ তাঁকে আকৃষ্ট করে। আকাশবাণী কলকাতা থেকে গান গাওয়ার সুযোগ তাঁর কণ্ঠস্বরকে পৌঁছে দেয় বৃহত্তর শ্রোতার কাছে। এই শহরেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাসগুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে তাঁর সঙ্গীত-সখ্য গড়ে ওঠে। ফলে আসামের লোকগীতির সুর মিশে যায় আধুনিক বাংলার সঙ্গীতধারায়।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। ১৯৬১ সালে ধূপছায়া ছবির সঙ্গীত পরিচালনা তাঁকে বিশেষ স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তী সময়ে চামেলি মেমসাহেব-এর গান তাঁকে সর্বভারতীয় খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। শুধু সুর নয়, গান লিখে, কণ্ঠে পরিবেশন করেও তিনি দর্শক-শ্রোতার মন জয় করেন।
কলকাতায় অবস্থিত ডঃ ভূপেন হাজারিকার বাড়ির একটি ছবি
শুধু বিনোদন নয়, সমাজসচেতনতার গানও রচনা করেছিলেন ভূপেন হাজারিকা। ষাট ও সত্তরের দশকে কলকাতার গণআন্দোলনের আবহে তাঁর প্রতিবাদী সুর তরুণ প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন গান সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে, আর সেই বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটেছে কলকাতার মঞ্চে, মহল্লার সভায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক আসরে।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে কলকাতা ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্রের কেন্দ্রবিন্দু। শহরের রেকর্ড সংস্থা, রেডিও ও দূরদর্শনের মাধ্যমে তাঁর গান ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার ঘরে ঘরে। তিনি পরিণত হন এক সাংস্কৃতিক প্রতীকে, যিনি একসঙ্গে আসামি, বাংলা ও হিন্দি গানে সেতুবন্ধ রচনা করেছিলেন।
ভূপেন হাজারিকার গানের কথা তাঁর সঙ্গে কলকাতার অন্তরঙ্গতা ফুটিয়ে তোলে। তিনি যখন গাইলেন, “মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে”, এই গান শুধু আসামের নয়, কলকাতার পথঘাটেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ষাট–সত্তরের দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতায় এই গান শহরের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। মিছিল, সভা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডা, সবখানে তাঁর কণ্ঠ যেন বলত, গানই মানুষের সর্বজনীন ভাষা।
আবার তিনি গেয়েছেন, “গঙ্গা আমার মা”, হুগলি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে এই গান শোনার সময় মানুষ অনুভব করেছে, কলকাতা কেবল একটি শহর নয়, বরং এক সভ্যতার ধারক। ভূপেন হাজারিকা এই নদীর স্রোতের মতোই বাংলা সংস্কৃতিতে প্রবাহিত হয়েছেন।
সত্তরের দশকে গণআন্দোলনের সময় তিনি কলকাতায় দাঁড়িয়েই গেয়েছেন, “বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের”, এ গান প্রতিবাদ আর আশার মেলবন্ধন। এ শহরের ছাত্রযুবা বুঝেছিল, গান শুধু বিনোদন নয়, পরিবর্তনের অস্ত্রও হতে পারে। শুধু তাই নয়, ভূপেন হাজারিকার কলকাতার স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি আজও দর্শনার্থীদের আকর্ষণ।
কলকাতা শহরের বুকে রয়েছে এক ঐতিহাসিক আস্তানা, যা আজও ভূপেন হাজারিকার স্মৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। দক্ষিণ কলকাতার গলিপথে অবস্থিত এই বাড়িতেই বহু বছর কাটিয়েছিলেন অসমের কিংবদন্তি গায়ক, কবি ও চলচ্চিত্রকার ভূপেন হাজারিকা। গানের সাধনা, সুরের নেশা আর অসংখ্য সাংস্কৃতিক আড্ডার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল এই বাড়ি।
কলকাতায় থাকাকালীন ডঃ ভূপেন হাজারিকার একটি ছবি
ষাটের দশকে যখন ভূপেন হাজারিকা কলকাতাকে নিজের দ্বিতীয় নিবাস হিসেবে বেছে নেন, তখন থেকেই এই বাড়ি হয়ে ওঠে তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। এখানেই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন বহু জনপ্রিয় গান, যার মধ্যে রয়েছে মানবতার মন্ত্রে উজ্জীবিত “মানুষ মানুষের জন্য” এবং আন্দোলনের প্রেরণা জাগানো “আগুন জ্বালো”। সেই সময়ের বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক, নাট্যকার ও সুরকারদের সঙ্গে তাঁর গভীর আলাপচারিতা হতো এই বাড়িতেই।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভূপেন হাজারিকা প্রায়শই জানালার পাশে বসে সুর বাঁধতেন। বাড়ির ছোট্ট অন্দরমহল থেকে আজও ভেসে আসে অতীতের প্রতিধ্বনি। ভূপেনপ্রেমীদের কাছে এই বাড়ি একরকম তীর্থক্ষেত্রের মতো। এখনও বহু শিল্পী ও সংস্কৃতিপ্রেমী এখানে এসে শিল্পীর স্মৃতি অনুসন্ধান করেন।
তবে বাড়িটির বর্তমান অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকে। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় অন্দরমহলের কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সাংস্কৃতিক মহল থেকে দাবি উঠেছে, শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ভূপেন হাজারিকার এই বাড়িকে সংরক্ষণ করা হোক। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন শিল্পী ও সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, বাড়িটিকে স্মৃতিসৌধ হিসেবে রূপ দেওয়ার জন্য।
সংস্কৃতি মন্ত্রকের এক আধিকারিক জানান, “ভূপেন হাজারিকার এই বাড়ি কেবল একটি ব্যক্তিগত বাসস্থান নয়, এটি ভারতীয় সঙ্গীত-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। খুব শিগগিরই এই বাড়ি সংরক্ষণের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
ভূপেন হাজারিকার জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী কিংবা বিশেষ দিনগুলিতে কলকাতার এই বাড়িতে ভক্ত ও অনুরাগীদের ভিড় হয়। মোমবাতি জ্বালিয়ে, তাঁর গান গেয়ে তাঁকে স্মরণ করেন সকলে। কলকাতার বুকে ভূপেন হাজারিকার এই স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি আজও যেন বলে যায়, শিল্পীর গান থেমে গেলেও, তাঁর সুর ও মানবিক বার্তা চিরকাল অমলিন থাকবে।
ভূপেন হাজারিকা আজ স্মৃতির মানুষ। কিন্তু তাঁর শিল্পীজীবনের প্রতিটি ধাপে কলকাতা যে ভূমিকা রেখেছে, তা শুধু ঐতিহাসিক নয়, এক আন্তরিক সম্পর্কেরও নিদর্শন। এই শহরের আঙিনায় দাঁড়িয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন লোকসঙ্গীতের বৈশ্বিক দূত, এক মানবতাবাদী কণ্ঠস্বর, যিনি গানকে মানুষের মুক্তির ভাষা করে তুলেছিলেন।