১) বাতুল বেগম : সঙ্গীত ঐতিহ্যের এক জীবন্ত উত্তরাধিকার
জয়পুরের রাজপথে গুঞ্জরিত একটি নাম বাতুল বেগম। রাজস্থানের মাটিতে জন্মগ্রহণ করা এই গায়িকা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। নগৌর জেলার কেরাপ গ্রাম থেকে আসা মুর্শিদ পরিবার ও মিরাচী সম্প্রদায়ের বাতুল বেগম সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সঙ্গীতের প্রতি গভীর আকর্ষণ গড়ে তুলেছিলেন।
বাতুল বেগম
তাঁর সুরেলা কণ্ঠ ও সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। বাতুল বেগমের কলা সমাজ ও রাজস্থানের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
২) আব্দুল সালাম জোহরঃ হাতের চুড়ি তৈরির পারম্পরিক শিল্পকে বিশ্বমান্যে পরিচিত করা
জয়পুরের গোলাপি দেয়াল ও রঙিন রাজপথে বিখ্যাত সুগন্ধি শুধু নয়, ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পও প্রবাহিত। এই শিল্পে লাখ লাখ টাকার চুড়ি তৈরি হয়, যা ঐতিহ্যের প্রতীক। এই শিল্পকে নতুন মাত্রা দিতে ও সমাজ সংস্কারের পথ তৈরি করতে আব্দুল সালাম জোহর নিজেকে নিবেদিত করেছেন। মণিহার সম্প্রদায়ের সাধারণ পরিবার থেকে উঠে বিশ্ববাজারে ‘জোহর ডিজাইন’, ‘জোহর কিং’ ও ‘ইন্ডিয়ান ক্রাফ্টস’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি সফল উদ্যোগী ও সমাজ সংস্কারক।
আব্দুল সালাম জোহর
ঠাকুরদা হাফিজ মোহাম্মদ ইসমাইল ও পিতৃ-মাতৃ হাজী আব্দুল আজিজ এবং হাজ্জন কামার জাহানের সংগ্রাম দেখে তিনি কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও সমাজসেবাকে জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। জয়পুরের ত্রিপলিয়া বাজারে তার পূর্বপুরুষের দোকান ‘ইন্ডিয়ান কংগন অ্যান্ড কালার স্টোর’ থেকে শুরু করে আজকের দিনে বিশ্ববাজারে ‘জোহর ডিজাইন’, ‘জোহর কিং’ ও ‘ইন্ডিয়ান ক্রাফটস’ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি কেবল সফল উদ্যোগী নন, সমাজ সংস্কারের পথপ্রদর্শকও।
৩) আব্দুল লতিফ ‘আর্কো’: ব্যবসা ও সমাজসেবার সমন্বয়
জয়পুর শহর শুধুমাত্র সংস্কৃতির কেন্দ্র নয়, সমাজ পরিবর্তনের পথিকৃৎ ব্যক্তিদের জন্যও পরিচিত। আব্দুল লতিফ সাহাব, যিনি ‘আর্কো’ নামে পরিচিত। ১৯৪৬ সালে ছোট্ট চমু গ্রামে জন্মগ্রহণ করা আব্দুল লতিফের কাহিনী সাধারণ পরিবার থেকে শুরু। কঠোর পরিশ্রম, সততা ও সাহায্যের আদর্শ তাঁর জীবন নির্মাণ করেছে।
আব্দুল লতিফ ‘আর্কো’
তার পিতা রহমাতুল্লাহ ও মাতা হাফিজানে তাঁকে কঠোর পরিশ্রম, সততা ও মানুষের সাহায্য করার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন, যা তার জীবনের আধার হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর কোম্পানি ‘আব্দুল রাজাক এন্ড কোম্পানি’ ইলেকট্রিক মোটর, ফ্যান ও কুলার সহ সমাজসেবায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ‘আর্কো পেলেস’ তাঁর দূরদর্শিতা ও পরিশ্রমের প্রতীক।
৪) মহিলা কাজী নিশাত হুসেন : কুসংস্কার ভাঙার নতুন কণ্ঠ
রাজস্থানের জয়পুর শহরের জোহরি বাজারের ছোট অফিস থেকে উঠে আসা কণ্ঠ সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রেরণা হয়ে উঠেছে। নিশাত হুসেন, রাজস্থানের প্রথম মুসলিম মহিলা কাজী, সমাজকর্মী ও মুসলিম মহিলাদের অধিকারের প্রবল সমর্থক। তার জীবনযাত্রা সাহস, সংগ্রাম ও পরিবর্তনের প্রতীক, যা হাজার হাজার মহিলাকে সচেতন করতে ও জীবনের নতুন দিশা দেখাতে সক্ষম হয়েছে।
কাজী নিশাত হুসেন
করৌলী জেলার সীতাবারী মহল্লায় জন্ম নেওয়া নিশাতের শৈশব কেটেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে, যেখানে তার পরিবারই ছিল অঞ্চলের একমাত্র মুসলিম পরিবার, আর তাদের বাড়ির সামনের দিকে তিনটি মন্দির। তিনি বলেন, "আমরা জানতাম না কে হিন্দু আর কে মুসলিম।" পিছিয়ে পড়া করৌলীর মতো অঞ্চলে মেয়েদের শিক্ষাকে গুরুত্ব না দেওয়া হলেও নিশাত ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার সময় ১২০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে একমাত্র মুসলিম ছাত্রী ছিলেন তিনি। আজ তার কণ্ঠ মুসলিম মহিলাদের অধিকারের প্রতীক।
৫) ক্যাপ্টেন মিরজা মোহতাসিম বেগ ও রুবী খানঃ সমাজসেবার অনুপ্রেরণাদায়ক দম্পতি
গোলাপি নগর নামে পরিচিত জয়পুর সমাজ উন্নয়নের জন্য নিয়মিত কাজ করা ব্যক্তিদের জন্য পরিচিত। এমন একটি প্রেরণাদায়ক দম্পতি হলো ক্যাপ্টেন মির্জা মহতাসিম বেইগ ও তার পত্নী রুবী খান। ক্যাপ্টেন মির্জা রাজস্থানের প্রথম মুসলিম পাইলট এবং গত ২৫ বছর ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিমানসেবা পরিচালনা করছেন।
ক্যাপ্টেন মিরজা মোহতাসিম বেগ ও রুবী খান
একই সময়ে তার পত্নী রুবী সক্রিয় সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ। তাদের বিশ্বাস, যদি আমরা সমাজে পরিবর্তন আনতে চাই, তবে নিজেদের উদ্যোগ নিতে হবে। তারা একসাথে মিলিত হয়ে চিকিৎসা শিবির, নথিপত্র শিবির, বিনামূল্যে রেশন বিতরণ এবং মেয়েদের বিবাহে সহায়তার মতো বহু সামাজিক প্রচেষ্টা শুরু করেছেন। এই দম্পতি প্রমাণ করেছেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজে বিশাল পরিবর্তন আনা সম্ভব।
৬) ডঃ আরিফ খান : গ্রামের বিজ্ঞানী
৩৪ বছর আগে রাজস্থানের হনুমানগড় জেলার মাসানী নামে ছোট্ট গ্রামে এক তারা উদয় হয়েছিল—ড° আরিফ খান। কষ্টকর জীবন, খোলা আকাশের তলে দিন রাত কাটিয়ে তার জন্ম হয়েছিল। তার পিতা আইনজীবী ফরিদ খান চাইতেন তার পুত্র ডাক্তার হোক। মা ও ঠাকুরদাও একই স্বপ্ন দেখতেন। মাসানীতে স্কুলের অভাব ছিল, তাই স্বপ্ন বাস্তবায়ন পথ কঠিন। তথাপি আরিফ খানের অন্তরে কিছু অর্জনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল।
ডঃ আরিফ খান
কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি জীববিজ্ঞানী হন এবং পরিবার ও গ্রামকে গৌরব বয়ে আনেন। দুধ ও খাদ্যগবেষণায় তার গবেষণা বিপ্লবী প্রভাব ফেলে। তার কাহিনী প্রমাণ করে যে যদি উদ্দেশ্য শক্তিশালী হয়, তবে গ্রাম্য ছেলে বিজ্ঞানী হয়ে দেশ গৌরবান্বিত করতে পারে।
৭) মাইনুনা নারগিস : শিল্প সংরক্ষণের প্রথম শিয়া মুসলিম মহিলা
ভারতের মতো বিশাল দেশে শিল্প সংরক্ষণ শুধু ইতিহাস সংরক্ষণ নয়, ভবিষ্যত প্রজন্মকে ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এই ক্ষেত্রে বিশেষ নাম দেশটির প্রথম ও একমাত্র শিয়া মুসলিম মহিলা শিল্প সংরক্ষক নারগিস।উত্তর প্রদেশের মোরাদাবাদ জেলার একটি ছোট শহর বাহজোয়িতে জন্মগ্রহণ করে মাইনুণা শৈশব সাধারণ হলেও স্বপ্ন ছিল অসাধারণ। রাজস্থান আজ তার দ্বিতীয় ঘর হিসেবে বিবেচিত।
মাইনুনা নারগিস
তার পিতা উত্তরপ্রদেশ পুলিশে কর্মরত ছিলেন এবং তিনি নারগিসকে সবসময় উৎসাহিত করতেন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (এ এম ইউ) থেকে ফাইন আর্টস অধ্যয়ন ও মিউজিয়োলজি-তে ডিপ্লোমা অর্জন তার জীবনের বড় টার্নিং পয়েন্ট হয়। নারগিসের গল্প শুধুমাত্র পেশাগত সফলতার নয়, এটি আবেগ, সংগ্রাম ও আত্মবিশ্বাসের গল্প, যা ইতিহাসের ভগ্নাংশ পুনর্জীবিত করে।
৮) যোগ গুরু নাইম খান : সঙ্গীত থেকে যোগের বিশ্বজয়
বালুচর রাজস্থানের সাংস্কৃতিক রাজধানী যোধপুরের রাস্তায় উঠে এসে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আধ্যাত্মিক আলো ছড়িয়ে দেওয়া যোগ গুরু নাইম খানের জীবনযাত্রা অনন্য উদাহরণ। সাধারণ মানুষের থেকে বিশ্বব্যাপী যোগ গুরুতে পরিণত হয়ে নাইম খান যোগকে ধর্ম, সংস্কৃতি ও সীমানার বাইরে সার্বজনীন শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
নাইম খান
নাইম খানের জন্ম এমন পরিবারে যেখানে সংগীত প্রতিটি নিঃশ্বাসে বিদ্যমান ছিল। তার ককাক উস্তাদ উমরদিন খান যোধপুর রাজপরিবারের দরবারি সংগীতজ্ঞ ছিলেন। অন্যদিকে মাতৃপক্ষের ককাক পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত সরোদবাদক উস্তাদ সুলতান খান। সময়ের পরিবর্তনে সংগীত ঐতিহ্য ম্লান হতে থাকলে নাইম ও ভাই ব্যবসায় জড়িত হন, কিন্তু যোগ তাকে নতুন দিশা দেয় এবং তিনি তা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলেন।
৯) পদ্মশ্রী সাকির আলী : ক্ষুদ্র চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষক
শিল্পের সৌরভ জয়পুরের বাতাস-মাটি সর্বদা মধুর করে রাখে। ক্ষুদ্র চিত্রকলার ক্ষেত্রে সাইয়দ সাকির আলীর নাম স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয়। পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত সাইয়দ সাকির আলী শুধুমাত্র এই শিল্পের মহান সাধক নন, রাজস্থানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের রক্ষক।
পদ্মশ্রী সাকির আলী
১৯৫৬ সালে উত্তরপ্রদেশের জলেছা গ্রামে জন্ম নিয়ে তার পরিবার পরবর্তীতে জয়পুরে স্থায়ী হয়। এখানেই তার শিল্পকর্ম নতুন মাত্রা লাভ করে। আজ তিনি শুধু ভারতেই নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে স্বীকৃতি এনে দিয়েছেন।
১০) সৈয়দ আনোয়ার শাহ : হাজার হাজার কন্যার শিক্ষার আলোকবর্তিকা
৩০ বছর আগে জয়পুরের ছোট একটি কোঠায় শুরু হয়েছিল একটি স্বপ্ন – যা আজ হাজার হাজার কন্যার শিক্ষার আলো। শায়েদ আনোয়ার শাহ, যাঁকে মানুষ আদরে ‘মাস্টার আনোয়ার শাহ’ বলে ডাকে। তিনি শুধু জীয়েকর শিক্ষার স্বপ্ন দেখেননি, সমগ্র সম্প্রদায়ের কন্যাসন্তানদের জন্য তা বাস্তবায়িত করেছেন।
সৈয়দ আনোয়ার শাহ
১৯৮০ সালে রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে ১৯৯৫ সালে তাঁর কন্যা আলিয়ার জন্মের সময় এই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপন করেন। আজ আল-জামিয়া-তুল আলিয়া শুধুমাত্র জয়পুরে নয়, ভারত ও বিদেশে জ্ঞান ও ইসলামী নৈতিকতার বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।