ডাঃ সলিম রাজ: ছত্তিশগড়ে ধর্ম, সংস্কার ও জাতীয়তার নতুন সংজ্ঞা

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 12 d ago
ডাঃ সলিম রাজ
ডাঃ সলিম রাজ
 
মন্দাকিনী মিশ্রা / রায়পুর

ছত্তিশগড়ের রাজনৈতিক পরিসরে, যেখানে সংখ্যালঘু সমাজের উন্নয়নের কণ্ঠস্বর প্রায়ই বৃহত্তর রাজনীতির আড়ালে হারিয়ে যায়, সেখানে ডাঃ সলিম রাজ এক দৃঢ়সংকল্প সংস্কারক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ধর্মকে দেশপ্রেমের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিক পরিবর্তন ও জাতীয় অগ্রগতির সহযাত্রী করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
 
দীর্ঘদিনের বিজেপি সদস্য রাজ বর্তমানে ছত্তিশগড়ে ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত, যা মন্ত্রিসভার মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন একটি পদ। তাঁর উত্থান কেবল রাজনৈতিক সাফল্যের গল্প নয়; এটি এমন এক ব্যক্তির যাত্রা, যিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিবাদের কেন্দ্র থেকে সামাজিক ও জাতীয় উন্নয়নের শক্তিতে রূপান্তরিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
 
ডাঃ সলিম রাজ
 
তিনি প্রায়ই বলেন, “ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেন বিতর্কের কেন্দ্র না হয়ে দেশের অগ্রগতির অংশীদার হয়।” ডাঃ রাজের কাছে জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম কোনও বিপরীত শক্তি নয়, বরং পরিপূরক, যা একত্রে বোনা দরকার। এই ধারণাকেই তিনি বলেন “সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষতা”।তাঁর মতে, যে মসজিদে শিক্ষামূলক কার্যক্রম নেই, সেগুলিকে শিশুদের শিক্ষায় এগিয়ে আসা উচিত, এভাবেই তারা জাতি গঠনে অবদান রাখতে পারবে।
 
রাজ মনে করেন, ওয়াকফ সম্পত্তিগুলোকে শিক্ষা ও সমাজকল্যাণের প্রসারে ব্যবহার করা উচিত; অচল সম্পত্তিগুলোকে সচল করে জাতির কাজে লাগাতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো তাঁকে যেমন প্রশংসা এনে দিয়েছে, তেমনি সমালোচনাও। সমর্থকদের কাছে তিনি সাহসী সংস্কারক, আর বিরোধীদের কাছে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপকারী। তবুও ফলাফল নিজেই কথা বলে। সমাজে শান্তি, সংলাপ ও সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরিতে তাঁর প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ধর্মীয় উৎসবগুলো এখন সংঘাত নয়, বরং ঐক্যের আবহে পালিত হচ্ছে।
 
তাঁর নেতৃত্বে ওয়াকফ বোর্ড সম্পত্তিগুলোর জরিপ শুরু করেছে এবং ভাড়ার কাঠামোকে নিয়মিত করছে, যা আয়ের স্বচ্ছতা ও অপব্যবহার রোধে সহায়ক হয়েছে। অচল সম্পত্তিগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, ফলে বোর্ডের আয় বেড়েছে। সাম্প্রতিক ওয়াকফ আইন সংশোধনকে রাজ “ঐতিহাসিক” বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, এটি দীর্ঘমেয়াদে ওয়াকফ সম্পত্তির সুরক্ষা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।
 
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ডাঃ সলিম রাজ
 
তাঁর ভাষায়, নতুন আইনি কাঠামো বোর্ডের কাজকর্মকে আরও পদ্ধতিগত ও কার্যকর করে তুলবে। তবুও, ডাঃ সলিম রাজের কাছে সংস্কার মানে কেবল সংখ্যা নয়, এটি আধুনিক সমাজে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নতুনভাবে ভাবা। তাঁর মতে, যদি ধর্মীয় সম্পদকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তবে তা জাতি ও সমাজ উভয়কেই শক্তিশালী করবে।
 
এই ভাবনা থেকেই তিনি ওয়াকফ সম্পত্তির অনধিকার দখলমুক্তির অভিযান শুরু করেছেন এবং সেগুলোকে জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করছেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, এই ধরনের প্রায় ৮৫ শতাংশ সম্পত্তি ইতিমধ্যে অবৈধ দখল থেকে মুক্ত করা হয়েছে। এখন এই সম্পদ স্কুল, হাসপাতাল ও কর্মসংস্থান প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, যা সরাসরি মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনছে।
 
রাজের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ওয়াকফ বোর্ডকে কেবল ধর্মীয় সংস্থা নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের একটি সম্পদকেন্দ্রে পরিণত করা। তিনি চান, ওয়াকফ সম্পত্তি যেন দারিদ্র্য বিমোচন ও যুবশক্তির বিকাশে ব্যবহৃত হয়।
 
ডাঃ সলিম রাজ বিজেপি অফিসে
 
তাঁর বক্তৃতায় তিনি প্রায়ই বলেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেন কেবল আচারেই সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের অগ্রগতিতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। এই চিন্তাধারার মাধ্যমে তিনি শুধু মুসলিম সমাজের প্রত্যাশাই নতুনভাবে গড়ে তুলেননি, বরং অন্যান্য ধর্মীয় সংস্থাকেও নিজেদের সামাজিক দায়িত্ব পুনর্বিবেচনা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
 
তাঁর নীতির পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক কৌশল ও নৈতিক বিশ্বাসের মিশ্রণ। বিজেপির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রশাসনের কার্যপদ্ধতি ও সংখ্যালঘু সমাজের সংবেদনশীলতা দুটোই বুঝতে সাহায্য করেছে। এই দুই দিকের ভারসাম্যই তাঁকে সংস্কারের জটিল পথে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁর সমালোচকরা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে তিনি ছত্তিশগঢ় ওয়াকফ বোর্ডকে এক নতুন পথে পরিচালিত করেছেন।
 
তিনি “সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষতা”-র ধারণাকে আরও বিস্তৃত করে তোলেন, যেখানে দেশপ্রেম ও ধর্মের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই, বরং একে অপরকে শক্তিশালী করে। রাজের মতে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উচিত শিশুদের শিক্ষায়, নাগরিক দায়িত্ববোধে ও সমাজগঠনে ইতিবাচক ভূমিকা নেওয়া। ওয়াকফ সম্পদকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ব্যবহার করে তিনি এক নতুন প্রজন্মকে জাতীয় উন্নয়নের অংশীদার করতে চান।
 
ডাঃ সলিম রাজকে অভ্যর্থনা জানানোর একটি মুহূর্তে
 
ফলাফল ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান। তাঁর নেতৃত্বে সমাজে উত্তেজনা কমেছে, জুমার খুতবা আরও নৈতিকতা ও নাগরিক দায়িত্বমুখী হয়েছে, এবং ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উদ্যোগে ব্যবহৃত হচ্ছে। বোর্ডের আয় বেড়েছে, মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। মসজিদে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের তাঁর উদ্যোগ ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের মর্যাদাপূর্ণ সহাবস্থানকে প্রতীকীভাবে প্রকাশ করেছে।
 
তবে তাঁর পথ সহজ ছিল না। প্রতিটি সংস্কারের বিপরীতে এসেছে বিরোধিতা, নিকাহ ফি সীমাবদ্ধতা থেকে শুরু করে দখলকৃত সম্পত্তি উদ্ধারের পদক্ষেপ পর্যন্ত। এমনকি বিদেশ থেকেও এসেছে হুমকি। তবুও রাজ নির্ভীক থেকেছেন, কারণ তাঁর কাছে বিরোধিতা প্রমাণ করে যে তাঁর উদ্যোগ প্রয়োজনীয়।
 
ডাঃ সলিম রাজকে আলাদা করে তোলে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার সঙ্গে বৃহত্তর উদ্দেশ্যের স্পষ্ট বোধ। তিনি নিজেকে কেবল রাজনীতিক হিসেবে নয়, একজন সংস্কারক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করেছেন, যিনি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে যেতে চান।
 
ডাঃ সলিম তাঁর অফিসে
 
ওয়াকফ সম্পত্তি মুক্ত করা থেকে শুরু করে নিকাহ ফি নিয়ন্ত্রণ, ধর্মোপদেশে দায়িত্ববোধের বার্তা, কিংবা জাতীয় পতাকা উত্তোলন, প্রতিটি পদক্ষেপেই এই নীতিই প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কাজ প্রমাণ করেছে, ঐতিহ্য ও স্বচ্ছতা পাশাপাশি চলতে পারে, আর ধর্ম সমাজ সংস্কারের সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারে।
 
আজ ডাঃ সলিম রাজকে কেবল এক চতুর রাজনৈতিক কৌশলবিদ নয়, বরং এক দূরদর্শী সংস্কারক হিসেবেও দেখা হয়। তাঁর উদ্যোগে শুধু মুসলিম সমাজই নয়, ছত্তিশগড়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোও মজবুত হয়েছে। সম্পত্তি উদ্ধার, শিক্ষা উন্নয়ন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সবক্ষেত্রেই তিনি ধর্মীয় সম্পদকে জনকল্যাণের সঙ্গে যুক্ত করেছেন।
 
ছত্তিশগড়ের জন্য, এবং সম্ভবত ভারতের জন্যও, ডাঃ সলিম রাজের এই পরীক্ষা এমন এক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে ধর্ম ও সংস্কার একসঙ্গে এগিয়ে চলে; যেখানে ধর্মীয় সম্পদ আর নিস্ক্রিয় নয়, বরং জাতীয় অগ্রগতির সক্রিয় অংশীদার।