মন্দাকিনী মিশ্র / রায়পুর
রায়পুরের রাজনীতিতে যখন পরিবর্তন, উন্নয়ন আর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হবে, তখন এজাজ ধেবরের নাম অনিবার্যভাবে উচ্চারিত হবে। সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে তিনি শুধু মেয়র হননি, বরং হয়ে উঠেছিলেন নাগরিক গর্ব, এক উদাহরণ যে নিষ্ঠা ও সেবার মনোভাব থাকলে সীমাবদ্ধতা বাধা হতে পারে না। তাঁর নেতৃত্বে রায়পুর পরিচ্ছন্নতা, সৌন্দর্যায়ন ও নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়, আর তাঁর জীবনগাথা প্রমাণ করে, রাজনীতি মানে কেবল ক্ষমতা নয়, মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া।
রায়পুরের পুরোনো এলাকা মৌলানা আব্দুল রউফ ওয়ার্ডে এক সাধারণ মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম । তাঁর পিতা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সংসারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে হত তাঁকে। তিনি প্রায়ই বলেন, “আমার পরিস্থিতি আমাকে থামায়নি, বরং এগিয়ে যেতে শিখিয়েছে।” ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এজাজ ধেবর রায়পুর পৌর নিগমের মেয়র হিসাবে নির্বাচিত হন। কংগ্রেস পার্টি তাঁকে প্রার্থী করে, এবং তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী মৃ্ত্যুঞ্জয় দুবের (২৯ ভোট) বিরুদ্ধে ৪১ ভোটে জয়লাভ করেন।
বক্তৃতা দেওয়ার মুহূর্তে এজাজ ধেবরের একটি ছবি
তিনি বলেন, “আমি কখনও নিজেকে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতিনিধি ভাবিনি।” তাঁর নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে "অল ইন্ডিয়া মেয়রস কাউন্সিল"-এর জাতীয় সহ-সভাপতি করা হয়, যা পদে পৌঁছানো ছত্তিশগড়ের ইতিহাসে প্রথম মেয়র তিনি। তরুণদের জন্য তাঁর বার্তা সহজ কিন্তু গভীর, “ঘৃণা ও নেতিবাচকতায় শক্তি নষ্ট করো না। আজ রাজনীতি ও সমাজ দুটোই সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী যুবশক্তির প্রয়োজন।”
তিনি ছত্তিশগড়ের প্রথম মুসলিম মেয়র। তাঁর উত্থান প্রমাণ করেছে যে ধর্ম, জাতি বা আর্থিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতীয়র স্বপ্ন বাস্তব হতে পারে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ জন্মায় তাঁর, যখন বড় ভাই তাঁকে পৌর নির্বাচনের প্রচারে সহায়তা করতে বলেন। সেই থেকেই শুরু হয় তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন। প্রথমদিকে ওয়ার্ড স্তরে কাজের দায়িত্ব পান তিনি। তাঁর পরিশ্রম, সরলতা ও জনগণের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ তাঁকে দ্রুত পরিচিতি এনে দেয় রায়পুর পৌর নিগমে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এজাজ ধেবরের সাক্ষাৎকারের একটি মুহূর্ত
তিনি দু’বার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এবং ২০২০ সালের জানুয়ারিতে রায়পুরের মেয়র হন, রাজ্যের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম হিসেবে। তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদকাল স্মরণীয় উন্নয়ন, নগর সৌন্দর্যায়ন ও পরিচ্ছন্নতার জন্য। তাঁর নেতৃত্বে বুধা তালাব পুনরুজ্জীবিত হয়, নারীদের জন্য ‘পিংক টয়লেট’, বহুতল পার্কিং, কুকুর আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন, এবং সর্বোপরি, রায়পুরকে জাতীয় স্বচ্ছতা জরিপের শীর্ষ পাঁচ শহরের মধ্যে স্থান দেওয়া হয়।
তবে তাঁর মেয়াদকাল বিতর্কমুক্ত ছিল না। তাঁকে স্বচ্ছতার অভাব ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। কেউ কেউ তাঁকে “ব্যর্থ মেয়র” বলেও অভিহিত করেন। কিন্তু ধেবর এই অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিক কৌশল বলে উড়িয়ে দেন। ২০২৫ সালের পৌর নির্বাচনে বড় ধাক্কা খান তিনি, কাউন্সিলর আসন হারান। তবে তাঁর স্ত্রী, আরজুমান ধেবর, কাউন্সিলর নির্বাচনে জয়ী হন। পরাজয়ের পরেও আইজাজ রাজনীতি ও সমাজসেবায় সক্রিয় রয়েছেন। এখন তিনি তরুণ নেতাদের প্রশিক্ষণ দেন, নগরোন্নয়ন ও সংখ্যালঘু শিক্ষার উপর সেমিনার আয়োজন করেন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ছাত্রনেতা হিসেবে। একসময় তিনি ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার রাজ্য সভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতে পুনরায় প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে তিনি হাসতে হাসতে বলেন, “মানুষ যদি চায়, আমি আবার দাঁড়াব। কারণ আমি তো মানুষেরই লোক।” তিনি বলেন, রাজনীতি তাঁর কাছে কখনও পদ পাওয়ার উপায় ছিল না, বরং সমাজসেবার পথ। “ছোটবেলা থেকেই দেখেছি সাধারণ মানুষ কত সমস্যায় পড়ে ছোট ছোট বিষয়ে। তখনই ভাবতাম, অভিযোগে নয়, ব্যবস্থার ভেতরে থেকে কাজ করেই পরিবর্তন আনা যায়। তাই রাজনীতি বেছে নিয়েছি।”
একটি জনসভায় এজাজ ধেবর
তিনি রাজনীতিতে এসেছেন যাতে রায়পুরের গলিঘুঁজি থেকে শুরু করে সমস্ত বস্তিতে পানীয় জল, বিদ্যুৎ, নিকাশী ও রাস্তাঘাটের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। এই তৃণমূল অভিজ্ঞতাই তাঁর নেতৃত্বের ধরনকে গড়ে তুলেছে। তিনি বলেন, “আমার মেয়র পদে থাকা কালে রায়পুর জাতীয় স্তরে স্বচ্ছতা মিশনে স্বীকৃতি পেয়েছিল, সেটাই আমার জীবনের গর্বের মুহূর্ত। বুঝেছি, মানুষের সঙ্গে কাজ করলে তাঁদের আশীর্বাদই সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি।”
তবে তাঁর হৃদয়ে এখনো একটি অপূর্ণ স্বপ্ন রয়ে গেছে। তিনি বলেন, “রায়পুর আমার ঘর, আমার আত্মার শহর। আমার স্বপ্ন, রায়পুর ভারতের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও আধুনিক শহর হোক।” তাঁর ইচ্ছা, প্রতিটি যুবকের কর্মসংস্থান হোক, প্রতিটি শিশু ভালো শিক্ষা পাক, প্রতিটি পরিবার নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করুক। মেয়র হিসেবে তিনি রায়পুরকে পরিচ্ছন্নতার প্রতীকে পরিণত করেছিলেন, কিন্তু তাঁর বৃহত্তর স্বপ্ন, রায়পুরকে উদ্ভাবন ও সুযোগের রাজধানী করা, যেখানে উন্নয়ন সমতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলবে।
তাঁর বিশ্বাস, প্রযুক্তি, স্টার্ট-আপ, মানসম্মত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তরুণরা সমাজ গঠনে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, “আমি সবসময় রাজনীতিকে বিরোধিতার নয়, সমাধানের মঞ্চ হিসেবে দেখেছি, এটিই তরুণদের প্রতি আমার বার্তা।” একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পুত্র থেকে রায়পুরের প্রথম মুসলিম মেয়র হয়ে ওঠার তাঁর যাত্রা প্রমাণ করে যে নিষ্ঠা ও জনসেবা দারিদ্র্য, ধর্ম ও পক্ষপাতের প্রাচীর ভেঙে দিতে পারে।
ধেবর তাঁর মায়ের সঙ্গে
যেখানে পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি শিরোনামে থাকে, সেখানে এজাজ ধেবরের উত্থান এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর মেয়াদকালে তিনি সবসময় জোর দিয়েছেন, তিনি কোনও এক সম্প্রদায়ের নয়, সমগ্র নাগরিকের নেতা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষেরা যখন নানা ইস্যুতে তাঁকে আক্রমণ করেছে, তখনও তিনি নাগরিক উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তির কাজেই মনোনিবেশ রেখেছেন। তাঁর প্রকল্পগুলি, জনসাধারণের অবকাশ কেন্দ্র পুনর্নির্মাণ থেকে শুরু করে নারীবান্ধব উদ্যোগ, সবই ছিল সর্বজনীন কল্যাণের লক্ষ্যে। ছত্তিশগড়ের অনেকের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন উদাহরণ, কিভাবে সংখ্যালঘু নেতারা মূলধারার রাজনীতির নেতৃত্ব দিতে পারেন, পরিচয় রাজনীতির ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে।
তাঁর পথ ছিল কখনও সহজ নয়। দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হওয়া মানে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করা, কিশোর বয়সে রাজনীতিতে প্রবেশ মানে কোনও নিশ্চয়তা ছাড়াই শুরু করা। মেয়র হয়েও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে বিরোধিতা, সীমিত সম্পদে উন্নয়নের ভারসাম্য বজায় রাখার কঠিনতা। তবু প্রতিটি চ্যালেঞ্জ তাঁকে শিক্ষা দিয়েছে, দারিদ্র্য তাঁকে দিয়েছে সহমর্মিতা, তৃণমূল রাজনীতি শিখিয়েছে সংগঠনের কৌশল, বিরোধিতা শাণিত করেছে তাঁর মনোবল, আর পরাজয় স্মরণ করিয়েছে, নেতৃত্ব সবসময় জনগণের বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল।
ফিল্ড ভিজিট -এর সময় এজাজ ধেবরের একটি ছবি
২০২৫ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর এজাজ ধেবর এখন এক সন্ধিক্ষণে। পদে না থেকেও তিনি তরুণ নেতৃত্ব গঠনে, নগর প্রশাসন নিয়ে কর্মশালা আয়োজনে ও সংখ্যালঘু শিক্ষার প্রচারে ব্যস্ত। তাঁর ভাষায়, “এটা পিছু হটা নয়, বরং আমার মিশনের ধারাবাহিকতা।” তিনি রাজনীতিতে ফিরুন বা না ফিরুন, রায়পুরের নাগরিক জীবনে তাঁর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। তাঁর বহু প্রকল্প আজও শহরের পরিচয় গড়ে দিচ্ছে। আর তাঁর গল্প অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে সেই তরুণদের, যারা এখনো বিশ্বাস করে, রাজনীতি ইতিবাচক পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে।
এজাজ ধেবরের কাহিনি আধুনিক ভারতীয় নগর রাজনীতির পরিবর্তিত মুখের প্রতীক, যেখানে নেতা বিচার হয় ধর্ম বা পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়, বরং সমন্বিত উন্নয়ন সাধনের ক্ষমতায়। তিনি আজও ক্ষমতার করিডোরের বাইরে থেকেও রায়পুরকে পরিচ্ছন্ন, সবুজ, উদ্ভাবনী ও সমতাপূর্ণ শহর হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন লালন করে চলেছেন। তরুণ ভারতীয়দের জন্য তাঁর জীবন এক বার্তা, সমাজসেবার পথ যে কারও জন্য খোলা, যদি সে নিষ্ঠা, সততা ও অন্তর্ভুক্তির চেতনা নিয়ে হাঁটে।