হাজী ড. মোহসিন আলি সুহাইল
মন্দাকিনী মিশ্র / রায়পুর
ছত্তীসগড়ের সাংবাদিকতার জগতে হাজী ড. মোহসিন আলি সুহাইল এমন এক নাম, যিনি সংবাদকে শুধুমাত্র খবর হিসেবে নয়, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর কলম সত্যের প্রতীক, তাঁর লেখনী সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি প্রমাণ করেছেন, সাংবাদিকতা কেবল তথ্য পরিবেশনের কাজ নয়, এটি ন্যায়, মানবতা ও জনকল্যাণের প্রতি এক গভীর অঙ্গীকার। পরিবর্তনশীল মিডিয়া পরিসরেও তিনি সততা, সাহস ও দায়িত্ববোধের মশাল জ্বেলে রেখেছেন।
তিনি আশা করেন, নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরাও এই সততা ও গভীরতা ধরে রাখবে। তিনি বলেন, “শুধু ব্রেকিং নিউজের পেছনে ছুটো না। সমাজের মূলে যাও, সেখানে সত্য লুকিয়ে আছে। সাংবাদিকতা মানে পরিবর্তন আনা, আর পরিবর্তন আসে তখনই, যখন আমরা সত্য তুলে ধরি। যদি সততা ও তথ্যের নির্ভুলতা থাকে, তবে বড় মঞ্চ না থাকলেও একজন সাংবাদিক সমাজে প্রভাব ফেলতে পারেন।”
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রমন সিং - এর সঙ্গে হাজী ড. মোহসিন আলি সুহাইল
১৯৫৩ সালের ৭ মে জন্ম নেওয়া সুহাইল শৈশব থেকেই কৌতূহলী ও সমাজসচেতন ছিলেন। স্কুলজীবনেই তিনি চারপাশের অন্যায় নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। তিনি বলেন, “গ্রামে কোনো সমস্যা হলে আমি ভাবতাম, সবাই চুপ থাকে কেন? তখনই ঠিক করেছিলাম, বড় হয়ে আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলব।”
তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের শুরু ১৯৭৯ সালে একটি স্থানীয় সংবাদপত্র দিয়ে। তখন সুযোগ-সুবিধা সীমিত ছিল, কিন্তু তাঁর ইচ্ছাশক্তি ছিল সীমাহীন। নিজের প্রথম বাইলাইন ছাপা দেখার আনন্দ আজও তিনি মনে রাখেন, আরও গভীর তৃপ্তি পেয়েছিলেন যখন মানুষ তাঁকে জানিয়েছিল, তাঁর প্রতিবেদনের কারণে তাদের সমস্যা সমাধান হয়েছে। সুহাইলের কাছে সেটাই ছিল প্রকৃত পুরস্কার।
প্রিন্ট সাংবাদিকতা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে তিনি ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল মাধ্যমে কাজ শুরু করেন। রাজনীতি, শাসনব্যবস্থা, সামাজিক সমস্যা ও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম তাঁর প্রতিবেদনের মূল বিষয়। গভীর অনুসন্ধানী প্রশ্ন, তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ ও জবাবদিহিতার মানদণ্ডে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রাজনীতি, বৈষম্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গ্রামীণ উন্নয়ন, এই সব ক্ষেত্রেই তাঁর প্রতিবেদন সমাজে আলোড়ন তুলেছে।
বর্তমানে সুহাইল ছত্তীসগড় থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক আলমুকাদ্দস-এর সম্পাদক। এর আগে তিনি রাজ এক্সপ্রেস-এর ছত্তীসগড় নিউজ চিফ, ন্যাশনাল লুক (রায়পুর)-এর উপদেষ্টা সম্পাদক, এবং দৈনিক করণপ্রিয়া (কোরবা), দৈনিক ন্যায়ধীশ (লখনউ, এলাহাবাদ), হিন্দুস্তান মেল, ব্যবসায় হেরাল্ড (লখনউ)-এ গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। এছাড়াও তিনি রায়পুর সংবাদ–এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন।
ক্রিকেটার সৈয়দ কির্মানির সঙ্গে মোহসিন আলি সুহাইল
তাঁর কাজ আন্তর্জাতিক পরিসরেও পৌঁছেছে। তিনি লন্ডন, জানজিবার, শারজাহ, তেহরান, মাশহাদ, কুম, আম্মান, সিরিয়া, কারবালা, নাজাফ, মক্কা, মদিনা, জেদ্দা, কুয়েত, করাচি, হায়দরাবাদ ও লাহোরসহ বিভিন্ন দেশে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বহু উর্দু সাহিত্য ও সাংবাদিকতা সম্মেলনে।
নির্ভীক সাংবাদিকতার পথ কখনো সহজ নয়। বহুবার তাঁকে চুপ করানোর চেষ্টা হয়েছে, প্রতিবেদন দমন করার চেষ্টা হয়েছে। তিনি স্বীকার করেন, “কখনও কখনও মনে হয়, সত্য বলা যেন সবচেয়ে বড় অপরাধ। কিন্তু আমি স্থির করেছি, আমার কলম ভয়কে মাথানত করবে না। যতই চাপ আসুক, প্রকৃত সাংবাদিকতা মানে সত্য লেখা।”
ছত্তীসগড়ে সুহাইল সেই অল্প কয়েকজন সাংবাদিকের মধ্যে অন্যতম, যারা বরাবরই জনগণের স্বার্থকে সর্বাগ্রে রেখেছেন। সাধারণ মানুষের সংগ্রামকে কণ্ঠ দিয়েছেন, অন্যায় নীতির সমালোচনায় শিরোনামে থেকেছেন। পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমেও তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি তাঁকে তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
তাঁর কাছে সাংবাদিকতা শুধু পেশা নয়, এটি এক সামাজিক দায়িত্ব। তিনি বলেন, “সাংবাদিকের কাজ ক্ষমতাবানদের তোষামোদ করা নয়; বরং জনগণ ও শাসকের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা, যাতে জনগণের কণ্ঠস্বর শাসকের কানে পৌঁছায়।”
একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মোহসিন আলি সুহাইল
তাঁর অনেক প্রতিবেদন বাস্তব পরিবর্তন এনেছে। রায়পুর ও আশপাশের এলাকার স্বাস্থ্যব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে করা তাঁর অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ডাক্তার ও ওষুধের ঘাটতি এবং হাসপাতালের দুরবস্থা তদন্তে নির্দেশ দেওয়া হয়। গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থার উপর তাঁর প্রতিবেদন প্রকাশের পর শিক্ষক নিয়োগ ও বিদ্যালয় সংস্কার হয়। স্থানীয় সংস্থার দুর্নীতি নিয়ে নথিভিত্তিক রিপোর্টের পর সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তাঁর দৃষ্টি শুধু বড় নীতিগত প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ নয়, তিনি জলসংকট, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ভাঙা রাস্তা ইত্যাদি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যাও তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, “সাংবাদিকতার লক্ষ্য শুধু নীতিনির্ধারণ নয়, মানুষের প্রতিদিনের কষ্টও প্রকাশ করা।”
তাঁর কাজের স্বীকৃতি এসেছে নানা পুরস্কারে। ২০১০ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট (বিদ্যা বাচস্পতি) উপাধি দেয়। তিনি হুসাইনি ইসলামিক মিশন (লন্ডন) থেকে ‘নিসারে আদব’ পুরস্কার, পদ্মশ্রী ড. সরদার অঞ্জুম প্রদত্ত ‘মোহসিনে আদব’ পুরস্কার এবং ছত্তীসগড় সংখ্যালঘু কমিশনের সদ্ভাবনা পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়াও তিনি মোহসিনে মিল্লাত অ্যাওয়ার্ড, আমির খুসরো অ্যাওয়ার্ড, সুজনশ্রী অ্যাওয়ার্ড (জয়পুর), ছত্তীসগড় রত্ন সম্মান, কম্য একতা অ্যাওয়ার্ড, পাসবান-এ-আদব সম্মান ও সমাজ সেবা সম্মান পেয়েছেন।
একজন লেখক হিসেবেও সুহাইলের অবদান অনন্য। তাঁর গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে, এহসাসে পাঞ্জতন – নাতে পাক সালাত নোহে (হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি), অন্ধের উজালে (গজল), এহসাসে ওয়াতন (ত্রিভাষিক গজল সংগ্রহ), রোশনি কি লকিরে, সুহাইল কি গজলেন, এবং ফিকরে মোহসিন। তাঁর সাহিত্যেও সেই সত্যনিষ্ঠা, সংবেদনশীলতা ও সংস্কৃতিমূলক গভীরতা প্রতিফলিত হয়েছে, যা তাঁর সাংবাদিকতার পরিচয়।
একটি অনুষ্ঠানে পুরস্কার গ্রহণের মুহূর্তে হাজী ড. মোহসিন আলি সুহাইল
সংবাদপত্রের বাইরে তিনি সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায়ও সক্রিয়। তিনি ছত্তীসগড় উর্দু অ্যাকাডেমির (২০০৪, ২০০৫, ২০১৪) গঠন কমিটির সদস্য ছিলেন। মাদ্রাসা বোর্ড ও ইসলামিক মাদ্রাসা কমিটিতে কাজ করেছেন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য বিনামূল্যে উর্দু, আরবি ও হিন্দি শিক্ষা প্রদান করেছেন। তিনি রাজ্য হাজ কমিটি, ওয়াকফ বোর্ড ও মাদ্রাসা বোর্ডের সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন এবং উর্দু ভাষা ও সংখ্যালঘু অধিকারের পক্ষে সোচ্চার থেকেছেন।
তিনি ছত্তীসগড় গুলিস্তান-এ-আদব–এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, যা রাজ্যের অন্যতম প্রধান উর্দু সাহিত্য সংস্থা। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে গুলিস্তান আদব (২০০০), গুলিস্তা (২০০১), রাহবারে উর্দু, এবং সফর আমির কে গজলেন (আমির আলি আমির)। এছাড়াও তিনি তাঁর পিতা হাজী হাসান আলি হাসানের রচনাসমূহ—কহিঁ ধূপ কহিঁ ছাঁব, সিফারিশে হাসান, কুছ ছায়া কুছ ধূপ—সম্পাদনা করেছেন।
তাঁর সাংবাদিকতা, সাহিত্য, সমাজকর্ম ও নেতৃত্বের মাধ্যমে মোহসিন আলি সুহাইল এক বিরল সততা, সামাজিক প্রতিশ্রুতি ও সাহিত্যগভীরতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এমন এক সময়ে, যখন মূল্যবোধ ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, তিনি বিশ্বাস ধরে রেখেছেন যে কলম এক জনসাধারণের আস্থা—যার কাজ নীরবদের কণ্ঠ দেওয়া এবং সত্যকে প্রকাশ্যে আনা।