মেয়েদের অধিকারের প্রশ্নে আপসহীন হালিমা খাতুন

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 3 d ago
হালিমা খাতুন
হালিমা খাতুন
 
দেবকিশোর চক্রবর্তী 

বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার কোকো শ্যানেল একবার মন্তব্য করেছিলেন, "নারীরা সর্বদাই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী।"এটি এমন একটি বার্তা যা আজও সত্য। কেন? কারণ নারীরা সহজাতভাবে শক্তি, অধ্যবসায় এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা দিয়ে তৈরি। বিশ্বের সেরা ও সফল নারীরা নারীশক্তির আরাধনায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্য করেছেন। নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী রোজা পার্কস একবার বলেছিলেন,"আপনি যা করছেন তা যখন সঠিক, তখন তা নিয়ে কখনই ভীত হওয়া উচিত নয়"। আর এই মহীয়সী নারীদের প্রত্যেকটি কথা হালিমা খাতুনের জন্য অক্ষরে অক্ষরে প্রযোজ্য।
 
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার উত্তর মামুদপুরে হিঙ্গলগঞ্জ এলাকা। সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। এখানে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম হালিমা খাতুনের। দিন এনে দিন খাওয়া এই পরিবারে অর্থের যোগান বলতে ছিল তাঁর বাবা-মার বেসরকারিভাবে বিড়ি তৈরির কাজ। প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে তাঁরা পরিবারের খরচ চালান। কিন্তু দারিদ্র্যের মধ্যেও তাঁরা হালিমার শিক্ষার প্রতি সমর্থন জুগিয়েছেন এবং তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন। তাঁদের গ্রামে হালিমা খাতুন ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
 
'দিদি নাম্বার 1'-এর মঞ্চে হালিমা খাতুন 
 
কিন্তু এই পথ এত সহজ ছিল না। অনেক প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে। তীব্র সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল। অনেক অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন দৃঢ় মানসিকতার মানুষ। সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে নিজের লক্ষ্য অর্জন করেছেন। হার মানেননি এই জেদি প্রত্যয়ী নারী। কথা প্রসঙ্গে হালিমা স্মৃতিচারণ করে বলেন,“যখন আমি গ্রাম ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য কলকাতায় আসি, তখন সেটা একপ্রকার বিদ্রোহই ছিল। গ্রামে আমাকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। সেটা স্বাভাবিকই ছিল, কারণ আমি ছিলাম গ্রামের প্রথম মেয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিল।"
 
পড়াশোনা চলাকালীনই হালিমা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ বিশেষ করে নারীর উন্নতির জন্য কাজ করতে শুরু করেন। তিনি সেই সব নারীদের পথপ্রদর্শক হিসেবে এগিয়ে আসেন যারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রথম তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল সুন্দরবন এলাকার মৎস্যজীবী মহিলাদের পাশে দাঁড়ানো। তিনি এই মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেন এবং ক্রমাগত তাদের পাশে থেকে লড়াই চালিয়ে যান। 
 
হালিমার সামাজিক দায়বদ্ধতার মুহূর্তগুলো
 
কথায় আছে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আর এই ঐকান্তিক ইচ্ছেই হালিমা খাতুনকেও উপায়ের সন্ধান দেয়। ২০০৯ সালে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ পান। অ্যাকশনএইড ইন্ডিয়া নামে একটি সমাজসেবামূলক সংস্থার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান তিনি। এই সংস্থাটি উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় মুসলিম মহিলাদের নিয়ে কাজ শুরু করে, তখন তিনি এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁর নিজের ভাষায়, “গ্রামগুলো ছিল অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। বেশিরভাগ মানুষের ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ডও ছিল না। কীভাবে এই অধিকারগুলো পেতে হয়, সে বিষয়ে তারা মোটেই সচেতন ছিল না। আমাদের সম্প্রদায়ের মেয়েরা স্কুলে যায়, এমন দৃশ্য ছিল অত্যন্ত বিরল। যখন আমরা কাজ শুরু করি, তখন নারীরা কখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলত না। তারা সবসময় ভয় আর প্রভাবশালী লোকজনের চাপে নিম্নস্বরে জীবন কাটাত, যারা পুরুষতন্ত্রকে বজায় রাখার এবং মহিলাদের বঞ্চিত করার পেছনে সদা তৎপর ছিল।
 
তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয়। অ্যাকশনএইড ইন্ডিয়া-র সহায়তায় আমরা বিভিন্ন স্তরের নারীদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ও আলোচনা শুরু করি। বিভিন্ন সময়ে অন্য জেলাগুলির মহিলাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগও করে দিই।” 
 
সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে হালিমা খাতুন 
 
'আওয়াজ দ্যা ভয়েস' প্রতিনিধিকে হালিমা বলেন, “আমাদের এই হিঙ্গলগঞ্জ অঞ্চলে আর্থিকভাবে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া মানুষের বাস। নানা ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। এখনও পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মহিলা হাসনাবাদ-হিঙ্গলগঞ্জ মুসলিম মহিলা সংঘ (HHMMS)-এর অধীনে সংগঠিত হয়েছেন।  ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত জুড়ে কিশোরী মেয়েদের গ্রুপ গড়ে উঠেছে।" 
 
মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন হালিমা এবং HHMMS-এর অন্যান্য সদস্যরা।  তথ্য জানার অধিকার আইনের (RTI) আওতায় এখন পর্যন্ত ২১৫টি আবেদন দায়ের করেছেন তাঁরা। যার ফলে ৫৫০ জন মেয়ে বৃত্তি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে, নারী পাচার রুখতে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এখন পর্যন্ত তাঁরা অর্থ শতাধিক বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন এবং বহু কিশোরীকে পাচার থেকে উদ্ধার করেছেন।
 
বাল্যবিবাহ রোধের প্রচারে হালিমা
 
সমাজের উন্নয়নে বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া নিম্ন বিত্ত মানুষের জন্য হালিমা ও তাঁর সংগঠন নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে। তাঁদের প্রচেষ্টায় এখন পর্যন্ত ৭০০ জন বিড়ি শ্রমিক নিজেদের পরিচয়পত্র পেয়েছেন। হাসনাবাদ হিঙ্গলগঞ্জ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগণের একটা বড় অংশই বিড়ি শ্রমিক। পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক পান অত্যন্ত সামান্য। যার ফলে দৈনন্দিন জীবন যাপন পরিবার প্রতিপালন সব ক্ষেত্রেই জড়িয়ে আছে তুমুল দারিদ্র। অভাবের জায়গা থেকেই অনেক সময় অল্প বয়সি মেয়েদের বিয়ে দিতে বাধ্য হন বাবা মায়েরা। তাদের কারো কারো ধারণা বিয়ের পর যদি অভাবি পরিবারের মেয়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে একটু আধটু পুষ্টিকর খাবার পায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়। কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের রুখতে এই হালিমাকে অনেকেই "দাবাং" এর সঙ্গে তুলনা করেন। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে কত বিয়ে যে রুখে দিয়েছেন তিনি। 
 
আওয়াজ দ্যা ভয়েস'এর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খানিকটা হতাশার সুর যেন ঝরে পড়ল হিঙ্গলগঞ্জের প্রথম মাস্টার ডিগ্রীপ্রাপ্তা হালিমা খাতুনের গলায়। "চেষ্টা করে চলেছি কত বছর হয়ে গেল। আমরা দলবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজ করি। আমাদের এই বন্যা প্রবন বদ্বীপ অঞ্চলে চারিদিকে এত অভাব, এত অশিক্ষা যে কি বলবো। আমাদের সীমিত সাধ্য দিয়ে যথাসম্ভব লড়াই চালিয়ে  যাচ্ছি। জীবনে থেমে থাকতে শিখিনি। হারতেও নয়।"
 
বন্যার্তদের পাশে হালিমা খাতুন 
 
তবে সব এত সহজ ছিল না। এখনও হালিমার কাজকর্ম নিয়ে অনেক কট্টর পন্থীর চোখ রাঙানি নিয়মিত সহ্য করতে হয়।‌ সমাজের প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষী মহলের একাংশের বিরাগ ভাজন হয়েছেন তিনি।  বহুবার হুমকির ফোন পেয়েছেন যেখানে তাকে শারীরিক এবং যৌন নিগ্রহের ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা বলা হয়েছে। 
 
সময় ধরে লড়াই জারি রাখা হালিমা বলছেন, “জানেন, একটা সময় এলাকার কট্টরপন্থীরা বলত, এই শাস্তি আমার প্রাপ্য, কারণ আমি নাকি মহিলাদের তাদের অধিকার দাবি করতে উসকানি দিচ্ছি,তাদের ঘরের বাইরে এসে জগৎকে চেনার সাহস জোগাচ্ছি,” বলেন হালিমা। তবে তিনি আশাবাদী। কারণ তিনি এটাও জানেন একদিন নতুন সূর্যোদয় হবে। তিনি বলেন, “এই দমনমূলক শক্তিগুলোর মানসিকতা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে।তারা এখন প্রায়শই আমাকে মিডিয়াতে দেখে। আমাদের আন্দোলনের খবরে,আর সেই ইতিবাচক পরিবর্তনের গল্পগুলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করছে।"
 
হালিমার সামাজিক সংস্থার ত্রাণ বিতরণ 
 
শুধু সমাজ ও বর্হিবিশ্বে নয় পরিবর্তন এসেছে হালিমার নিজের জীবনেও। এখন তিনি বিবাহিত এবং এক সন্তানের মা। তবুও তিনি নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন এবং অনেককেই সংগ্রামে সামিল হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করছেন। 
 
তাঁর ভাষায়, “আমরা এখন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম মহিলাদের নিয়ে একটি বৃহত্তর মঞ্চ গঠনের প্রক্রিয়ায় রয়েছি, যার নাম পশ্চিম বঙ্গ মুসলিম মহিলা সংগঠন (Paschim Banga Muslim Mahila Sangathan)। এটা সত্যিই অত্যন্ত সন্তোষজনক যে, এখন মহিলারা সংগঠিত হচ্ছে, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে,আর নিজেদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে। যেটা কয়েক বছর আগেও প্রায় অসম্ভব ছিল।"