গটখিন্ডির অনন্য প্রথা: মসজিদের প্রবেশদ্বারে গণেশোৎসব, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 2 d ago
 গটখিন্ডি গ্রামের মসজিদে গণেশ প্রতিমা সহ হিন্দু ও মুসলিমরা
গটখিন্ডি গ্রামের মসজিদে গণেশ প্রতিমা সহ হিন্দু ও মুসলিমরা
 
ফজল পাঠান

সমাজকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামী লোকমান্য তিলক গণেশোৎসবের সূচনা করেছিলেন। আজও এই উৎসব ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের প্রতীক হয়ে আছে। মহারাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একত্রে উৎসব উদযাপন করতে দেখা যায়, যা ধর্মীয় ভেদাভেদকে ভেঙে দেয়।
 
তবে বিস্ময়ের বিষয় হলো, কোথাও কোথাও সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে একটি মসজিদের ভেতরেই গণেশমূর্তি প্রতিস্থাপন করা হয়।
 
মহরম, ঈদ কিংবা গণেশোৎসব, যেকোনো উপলক্ষেই মহারাষ্ট্রের সাংলি জেলায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। মহারাষ্ট্রজুড়ে হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্বের মানুষ একসাথে উৎসব পালন করে থাকেন, যার নানা প্রথা ও রীতি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যায়। সাংলি জেলার ওয়ালভা প্রশাসনিক ব্লকের অন্তর্গত গটখিন্ডি গ্রামও তেমনই এক অনন্য উদাহরণ, যা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে খ্যাত।
 
গটখিন্ডি বহু বছর ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। মহারাষ্ট্রজুড়ে এই গ্রাম খ্যাত গণেশোৎসব উদযাপনের জন্য, যা প্রকৃত অর্থেই হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতিফলন।
 
মহারাষ্ট্রের বহু স্থানে দারগাহ বা মসজিদের প্রাঙ্গণে গণেশমূর্তি প্রতিস্থাপন করে পূজা করা হয় গণেশোৎসবের সময়। গটখিন্ডির প্রথাটিও অনেকটা একই রকম। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এখানে স্থানীয় মসজিদের প্রবেশদ্বারেই গণেশমূর্তি স্থাপন করা হচ্ছে। এই প্রথার পেছনের ইতিহাসও সমানভাবে আকর্ষণীয়।
 
COVID-19 মহামারী চলাকালীন ওয়ালভা গ্রামে গণেশোৎসব
 
এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানাতে গিয়ে নিউ গণেশ মণ্ডল (স্থানীয় আয়োজক কমিটি)-এর সম্পাদক রাহুল কোকাটে বলেন, “৪৩ বছর আগে নিউ গণেশ মণ্ডল গটখিন্ডি গ্রামের ঝুঞ্জার চৌকে নিয়মিত মতোই গণপতি প্রতিস্থাপন করেছিল। তবে সেই বছর প্রবল বর্ষণে মূর্তির ওপর পানি পড়তে শুরু করে। তখন মণ্ডপের একেবারে পেছনে অবস্থিত মসজিদের প্রবীণ সদস্যরা আমাদের অনুরোধ করেন, গণেশমূর্তিটি বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে যেন মসজিদের ভেতরে নিয়ে আসা হয়।”
 
তিনি আরও বলেন, “আমাদের মুসলিম ভাইদের সেই সিদ্ধান্তের কারণে মূর্তিটি সুরক্ষিত ছিল। পরের বছর একটি গ্রাম সভা ডাকা হয়। সেখানে স্থির হয়, আগামী বছরগুলোতে মসজিদের প্রাঙ্গণেই গণেশ প্রতিস্থাপন করা হবে। উভয় সম্প্রদায় আনন্দের সঙ্গেই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। আগে মূর্তিটি মসজিদের বাইরের দিকে স্থাপন করা হতো। এখন সেটি স্থাপন করা হয় একেবারে প্রবেশদ্বারে।”
 
প্রায় চার দশক আগে গটখিন্ডির মুসলিম সমাজ গ্রামবাসী হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল। গণেশোৎসবের সময় মসজিদের প্রাঙ্গণে গণেশমূর্তি প্রতিস্থাপনের অনুমতি দিয়ে তারা হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। গ্রামটির সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায় আজও এই গণেশোৎসবের জন্য সর্বতোভাবে সাহায্য করতে সদা প্রস্তুত। উৎসব চলাকালীন মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকেরা সর্বদা সেবায় নিয়োজিত থাকেন। এমনকি বহু সময় দেখা যায়, আরতি শেষ হওয়ার পর প্রসাদ বিতরণের কাজও তারাই করেন।
 
২০০৯ সালে একই সাংলি জেলার মিরজ শহরে গণেশোৎসবের সময় ভয়াবহ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা তৈরি হয়। তবে কয়েক কিলোমিটার দূরের গটখিন্ডি গ্রামে সবকিছু শান্তিপূর্ণ ছিল। দাঙ্গার সময়ও এখানকার হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও ধর্মীয় সম্প্রীতি অটুট থেকেছিল।
 
গত কয়েক বছরে দুই-তিনবার এমন হয়েছে, যখন বকরিদ ও অনন্তচতুর্দশী একই দিনে পড়েছে। বকরিদ মুসলিমদের প্রধান উৎসবগুলির একটি, আর অনন্তচতুর্দশী হলো হিন্দুদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, যেদিন গণেশ বিসর্জনের শেষ দিন পালিত হয়। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম সম্প্রদায় সেদিন বকরিদ উদযাপন করেননি। অনন্তচতুর্দশী শেষ হওয়ার পরেই মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দ কুরবানি সম্পন্ন করে নিজেদের উৎসব পালন করেছেন।
 
সম্পাদক রাহুল কোকাটে বলেন, “১৯৮৬ সালে এবং আবার ২০১৮-১৯ সালে মহরম ও গণেশোৎসব একই সময়ে পড়েছিল। সেই সময়ও হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় একসঙ্গে এগিয়ে এসে একই স্থানে মহরমের পাঞ্জা (পবিত্র প্রতীক) এবং গণেশমূর্তি প্রতিস্থাপন করেছিল।”
 
গণেশোৎসব মহারাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান উৎসব। এই সুযোগে গণ-কমিটিগুলি টানা দশ দিন ধরে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। নিউ গণেশ মণ্ডলের হিন্দু ও মুসলিম যুবকেরা বিপুল সংখ্যায় একত্রিত হয়ে শিক্ষামূলক ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি সম্পাদন করে। এ সময় তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, বিপুল উৎসাহে গণেশোৎসবকে সফল করে তোলে।
 
গটখিন্ডির মুসলিম সম্প্রদায় সর্বদা তাঁদের হিন্দু ভাইদের উৎসবে উচ্ছ্বাসভরে অংশগ্রহণ করে। গ্রামের মুসলিম সদস্যরা বলেন, “যে-ই উৎসব হোক না কেন, সব কমিটি সদস্যরা পরস্পরের বাড়িতে আত্মীয়ের মতোই যান। উৎসবের সময় ‘আমরা হিন্দু’ বা ‘আমরা মুসলিম’, এই ভাবনা আমাদের মনে আসে না। আমরা সবাই মিলে একই পরিবারের মতো একত্রে নানা উৎসব উদযাপন করি।”
 
গটখিন্ডি গ্রামে হিন্দু-মুসলিম মিলনের যে অনন্য দৃষ্টান্ত গত চার দশক ধরে গড়ে উঠেছে, তা আজ সমগ্র জাতির কাছে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের এক উজ্জ্বল বার্তা বহন করছে। মহারাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে এই ঐতিহ্য গোটা দেশের জন্য এক প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।