শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
	
	
	কলকাতার হালকা হিমেল হাওয়ায় এখন আর নেই সেই কনকনে শীতের ছোঁয়া। বছর কয়েক ধরেই আবহাওয়ার এই অনিশ্চয়তা যেন শীতের পোশাক বাজারের হিসেব-নিকেশই পাল্টে দিয়েছে। একসময় শীত এলেই শহরের অলিতে গলিতে কাশ্মীরি শালের বিক্রেতাদের ভিড় জমত, আর মানুষ উৎসাহ নিয়ে ঘরে ঘরে তাঁদের ডেকে শাল কিনতেন। আজ সেই দৃশ্য ইতিহাস হতে চলেছে।
	 
	কলকাতার রাস্তায় এখন আর আগের মতো ঘুরে বেড়ান না শালওয়ালারা। কেউ কেউ এলেও বাড়ির দরজায় ডাকে সাড়া মেলে না। “সব আছে বাড়িতে,” বা “অনলাইনেই তো এখন সস্তায় পাওয়া যায়”, এমন উত্তর শুনে মুখ কালো করে ফিরে যান তাঁরা। এই বাস্তবতাই বদলে দিয়েছে বহু কাশ্মীরি বিক্রেতার জীবনযাত্রা। কেউ কেউ ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন, কেউ আবার পেশা পালটেছেন। অনেকেই এখন ট্যুর গাইড কিংবা ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। তবে, অনেকে এখনও বাপ-দাদার পুরনো পেশাতেই অনড় রয়েছেন, ভরসা রাখছেন পুরনো ক্রেতাদের বিশ্বাসে।
	 
	কাশ্মীরি শাল হাতে ব্যবসায়ী নিসার ডার
	 
	এমনই এক শাল ব্যবসায়ী নিসার ডার। প্রায় ৩০ বছর ধরে কলকাতায় আসছেন তিনি। মুখে হালকা হাসি নিয়ে বললেন, “আগে এখানে কত ঠান্ডা পড়ত! তখন খুব ভালো ব্যবসা হতো। এখন তেমন ঠান্ডা নেই। নতুন গ্রাহকরা বলে, ‘আমার আছে, লাগবে না।’ তবে যাঁরা আগে থেকে চেনেন, তাঁরা এখনও আমাদের কাছ থেকেই কিনে নেন।” ব্যবসার মন্দা থাকা সত্ত্বেও নিসারের কাছে পেশা বদলের কথা ভাবাই কঠিন। “আমি অন্য কিছু করতে পারব না। এটাই আমার রুজি, এটাই জীবন,” জানালেন তিনি।
	 
	একই ছবি দেখা যাচ্ছে পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরেও। একসময় পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে কাশ্মীরি শাল বিক্রি করতেন শফিক আহমেদ। এখন তিনি বেনাচিতি বাজারে নিজের ছোট্ট শোরুম চালান। কিন্তু বিক্রি? তাঁর কথায়, “এখন শালের চাহিদা অনেক কমে গেছে। শীত তেমন পড়ে না, আর মানুষ অনলাইনেই কিনে নেয়।” ৩৮ বছর ধরে দুর্গাপুরে ব্যবসা করছেন শফিক। পরিবর্তনের স্রোতে তিনি এখন নতুনভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, একজন ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে।
	 
	“আমি এখন কাশ্মীর ট্যুরের প্যাকেজ বানাই,” বললেন শফিক আহমেদ। “অনেকেই আমার মাধ্যমেই ভূস্বর্গ কাশ্মীরে ভ্রমণে যাচ্ছেন। আগে যাঁরা আমাদের কাছ থেকে শাল কিনতেন, এখন তাঁরা ট্যুর বুক করছেন।”
	 
	দোকানে কাশ্মীরি শালের প্রদর্শনী
	 
	জলবায়ুর পরিবর্তন আর ই-কমার্সের দাপটে ক্ষতিগ্রস্ত এই কাশ্মীরি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের জীবন আজ নতুন পথে হাঁটছে। অনেকেই কাশ্মীর ফিরে গিয়ে স্থানীয় ট্যুরিজম ব্যবসায় জড়াচ্ছেন। তবে, তাঁদের চোখে এখনও পুরনো কলকাতার স্মৃতি, সেই ঠান্ডায় মোড়া সকাল, শালের পসরা নিয়ে ঘরে ঘরে যাওয়া, হাসিমুখে দরাদরি, আজও তাঁদের মনের কোণে উজ্জ্বল।
	 
	শীতের খামখেয়ালিপনায় যে এক সময়ের জমজমাট কাশ্মীরি শাল ব্যবসা আজ ধুঁকছে, তাতে সন্দেহ নেই। হয়তো একদিন শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানো সেই কাশ্মীরি বিক্রেতাদের চেনা ছবি পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। তবু কিছু মানুষ রয়েছেন, যাঁদের কাছে এই পেশা শুধু ব্যবসা নয়, এক ঐতিহ্য, এক উত্তরাধিকার। আগামী দিনই বলবে, কলকাতার এই ঐতিহ্য টিকবে, না হারিয়ে যাবে কালের স্রোতে।