এক ব্যাঙ্কার, বহু রূপে সমাজসেবক: ইব্রার আহমেদ

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 4 d ago
ইব্রার আহমেদ
ইব্রার আহমেদ
 
জেব আখতার / রাঁচি

রাঁচি শহরে সমাজকল্যাণের জন্য নিজের জীবনের তিন দশকেরও বেশি সময় উৎসর্গ করেছেন ইব্রার আহমেদ। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি সমাজের প্রান্তিক মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যেখানে কোনও শিশু টাকার অভাবে স্কুলছুট হয়, অসহায় রোগী চিকিৎসার আশায় দরজায় দরজায় ঘোরে, কিংবা সাম্প্রদায়িক অশান্তি মানুষের হৃদয়ে দেয়াল তোলে, সেখানে উপস্থিত হন ইব্রার আহমেদ। তাঁর কাজের পরিধি শুধু আর্থিক সহায়তায় নয়, বরং মানুষের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায়ও সমানভাবে প্রসারিত।

একসময় পেশায় ব্যাঙ্কার এবং ভারতীয় পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (IPTA)-এর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ইব্রার ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুই স্তরেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তিনি মৌলানা আজাদ হিউম্যান ইনিশিয়েটিভ (মাহি), সমাজা (সাজা মঞ্চ ঝাড়খণ্ড) ও মজলিস-এর মতো সংগঠনের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
 
শিশুদের সঙ্গে ইব্রার আহমেদ
 
"Anjum Ibrar Foundation"-এর পরিচালক হিসেবে তিনি নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবহার করে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আগস্ট ২০১৩ থেকে আগস্ট ২০২২ পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাঁচির আনজুমান ইসলামিয়া ও তার হাসপাতালের সভাপতি। এছাড়া তিনি রেড ক্রস সোসাইটি, YMCA, ঝাড়খণ্ড চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং কান্ট্রি ক্রিকেট ক্লাবের আজীবন সদস্য।
 
ইব্রার আহমেদ বিশ্বাস করেন, “শিক্ষাই সেই চাবিকাঠি, যা সমাজের বন্ধ তালা খুলতে পারে।” এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি শিশু ও তরুণদের শিক্ষার প্রসারে নিরন্তর কাজ করেছেন। আনজুমান ইসলামিয়ার সভাপতি থাকাকালীন তিনি দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেন, প্রতিযোগিতা ও কুইজ আয়োজন করেন, যাতে শিক্ষা বইয়ের সীমায় না থেকে আত্মবিশ্বাস ও বাস্তব দক্ষতা গঠনে সহায়তা করে।
 
একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার মুহূর্তে ইব্রার আহমেদ
 
মহল্লা শিক্ষা কেন্দ্র কোভিড মহামারির সময়, যখন স্কুল বন্ধ ছিল এবং অনলাইন ক্লাস কেবল স্মার্টফোন বা ল্যাপটপধারী ছাত্রদের নাগালে ছিল, তখন হাজার হাজার শিশু শিক্ষার বাইরে চলে যাচ্ছিল। সেই সময় ইব্রার আহমেদ শুরু করেন “মহল্লা শিক্ষা কেন্দ্র” উদ্যোগ। হিন্দপিরি, আজাদ বস্তি ও আলীনগরের মতো অসুবিধাগ্রস্ত এলাকায় ছোট ছোট শ্রেণিকক্ষ গড়ে তোলা হয়, যেখানে কলেজপড়ুয়া ও স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকরা শিশুদের পড়াতেন। বই ও খাতা বিনামূল্যে দেওয়া হতো, এবং স্বাস্থ্যবিধিও মানা হতো কড়াভাবে।
 
শিক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ করতে, ২০২০ সালে তিনি কাঁকে ব্লকের পিরুতোলা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন মৌলানা আজাদ লাইব্রেরি ও স্টাডি সেন্টার, যেখানে একসময় বই ছিল এক স্বপ্নমাত্র। এই গ্রন্থাগার গ্রামের শিশু-কিশোরদের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। প্রতি বছর মৌলানা আজাদের জন্মবার্ষিকীতে আয়োজিত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মেলায় শত শত শিশু নাচ, বক্তৃতা ও কুইজ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের প্রতিভা প্রকাশ করে।
 
শিশুদের সঙ্গে ইব্রার আহমেদ
 
সংখ্যাতীত মেয়ের আত্মবিশ্বাসের গল্প "মাহি"-এর ব্যানারে তিনি আয়োজন করেন দ্রুত গণিত ও বৈদিক গণিত কর্মশালা, যেখানে বিপুল সংখ্যক মেয়েরা অংশ নেয়। ইব্রারের মতে, শিক্ষা কেবল ডিগ্রি অর্জনের উপায় নয়, বরং আত্মবিশ্বাস গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। তিনি বলেন, “যদি শিক্ষা শিশুদের স্বপ্নকে ডানা দেয়, তবে স্বাস্থ্য সেই শ্বাসযন্ত্র যা দরিদ্রের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখে।”
 
স্বাস্থ্য ও মানবতার মেলবন্ধন রাঁচির আনজুমান ইসলামিয়া হাসপাতালের সভাপতির দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি একাধিক সংস্কার আনেন। চিকিৎসা সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করে তোলেন, যাতে গরিব মানুষও নির্দ্বিধায় হাসপাতালে যেতে পারে। দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, ফলে হাসপাতাল হয়ে ওঠে বিপন্ন মানুষের আশ্রয়স্থল। "মাহি"-এর মাধ্যমে নিয়মিত বিনামূল্যের মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন করা হয়, যেখানে হিন্দপিরি ও আশপাশের এলাকায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগের পরীক্ষা ও চিকিৎসা দেওয়া হয়। একেকটি ক্যাম্পে ৯০ জনেরও বেশি রোগী চিকিৎসা পান।
 
স্বাধীনতা দিবসে ইব্রার আহমেদের একটি ছবি
 
ইব্রারের বিশ্বাস, সমাজসেবা মানে কেবল চিকিৎসা নয়, বরং মানবমর্যাদা রক্ষা। তিনি বলেন, “স্বাস্থ্যসেবা দান নয়, এটি দরিদ্রের অধিকার।” সংস্কৃতির মাটিতে শিকড় রাজ্য IPTA-র সভাপতি হিসেবে ইব্রার আহমেদ সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়েছেন। লোকশিল্পীদের সঙ্গে মিলে তিনি ৫১ পর্বের এক তথ্যচিত্র সিরিজ “জোহার ঝাড়খণ্ড” তৈরি করেন, যা দূরদর্শনে প্রচারিত হয়।
 
২০১৪ সালে রাঁচির কাছে সিলগাই-ছানহো এলাকায় যখন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটে, তখন তিনি নীরব দর্শক হয়ে থাকেননি। পদ্মভূষণপ্রাপ্ত মুখুন্দ নায়ক ও শিল্পী মধু মনসুরির সঙ্গে এক শান্তি-দল গঠন করে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আস্থা পুনর্গঠনের প্রয়াস সফল হয়, এবং পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে।
 
একটি অনুষ্ঠানে ইব্রার আহমেদ
 
ইব্রার আহমেদের সমাজসেবা তাঁর লেখনিতেও প্রতিফলিত। তিনি ছোটা নাগপুর মেল ও আলাম-এ-ঝাড়খণ্ড পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং পরে সবরং নামে এক নিউজ চ্যানেল চালু করেন। তাঁর সাংবাদিকতা শুধু খবর প্রচার নয়, বরং নিঃশব্দদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরা ও প্রাসঙ্গিক বিষয় সামনে আনার এক সজাগ প্রয়াস ছিল।
 
ইব্রার আহমেদের গল্প কোনও উপসংহারে থেমে যায় না, প্রতিদিনই নতুনভাবে রচিত হয়। কখনও কোনও শিশু মহল্লা শিক্ষা কেন্দ্রে বই হাতে নিচ্ছে, কখনও কোনও দরিদ্র রোগী হাসপাতালে নিঃশ্বাস নিচ্ছে স্বস্তিতে, কিংবা কখনও দুই সম্প্রদায় পুনর্মিলনে আলিঙ্গন করছে, সবখানেই তাঁর কাজের ছাপ স্পষ্ট।
 
তিনি নিজের ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়েছেন, ব্যবসা সামলেছেন, কিন্তু প্রকৃত পরিচয় গড়ে তুলেছেন মানুষের মাঝে। মাহি, সমাজা, মজলিস, আনজুমান ইসলামিয়া, আনজুম ইব্রার ফাউন্ডেশন ও আরও বহু প্রতিষ্ঠানে তাঁর ভূমিকা প্রমাণ করে, তিনি কখনও নিজেকে একটি মহল্লা বা গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। রাঁচি ও ঝাড়খণ্ডের মাটি আজ সাক্ষ্য দেয়, ইব্রার আহমেদ তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন মানবতার শিখা জ্বালিয়ে রাখতে।