মুন্নী বেগম , গুয়াহাটি:
বয়স মাত্র ২৩ বছর, তবুও সমাজের জন্য কাজ করে নজির গড়ে রেখে চলেছেন নানা অবদান।যেগুলো অনেকের কাছেই কেবল স্বপ্নের মতো। তিনি হলেন নাহিদ আফ্রিন। স্কুলজীবন থেকেই নাহিদ তাঁর বিভিন্ন কৃতিত্বের মাধ্যমে অসমবাসীকে গর্বিত করে চলেছেন।
নাহিদ প্রথমবার খ্যাতি অর্জন করে যখন তিনি ২০১৫ সালের ইন্ডিয়ান আইডল জুনিয়র-এর সংস্করণে দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছিলেন। এরপর ২০১৬ সালে, সোনাক্ষী সিনহা অভিনীত আকিরা ছবির মাধ্যমে বলিউডে প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন নাহিদ। আর ২০১৮ সালে, যখন ইউনিসেফ ইন্ডিয়া তাঁকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য ‘শিশু অধিকার চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে মনোনীত করেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত নাহিদ একজন স্কুলছাত্রীই ছিলেন, এবং এই কৃতিত্বগুলোই সমাজের প্রতি তাঁর অবদানের কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী নাহিদ ইউনিসেফ ইন্ডিয়ার যুব অধিবক্তা হিসেবে বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক হুমকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি বড় ভূমিকা পালন করে চলেছেন। নাহিদ আরও তিনজন যুব অধিবক্তার পাশাপাশি বলিউড তারকা করিনা কাপুর খানের সঙ্গে কাজ করছেন, যিনি ইউনিসেফ-এর জাতীয় শুভেচ্ছাদূত। বাল্যবিবাহ ছাড়াও, তাঁরা জলবায়ু কর্মসূচি, মানসিক স্বাস্থ্য, উদ্ভাবন, এবং "গার্লস ইন STEM" (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত)–এর মতো জটিল বিষয়গুলির পক্ষে চ্যাম্পিয়নশিপের কাজ করছেন।
ইউনিসেফের যুব অধিবক্তা হিসেবে নাহিদ
২০১৮ সালে ইউনিসেফ অসম বিধানসভায় বাল্যবিবাহ সম্পর্কিত একটি কর্মসূচির আয়োজন করেছিল। সেই সময়ের বিধানসভার অধ্যক্ষ সমাজে বাল্যবিবাহের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এবং কীভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করেন। নাহিদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বাল্যবিবাহবিরোধী কার্যক্রম ও অভিযানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
২০২৩ সালে ইউনিসেফের ভারতীয় আঞ্চলিক দপ্তর থেকে নাহিদের কাছে একটি ফোন আসে, যাতে জানানো হয় যে তাঁকে তাঁদের যুব অধিবক্তা হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। এই পদটির জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে নাহিদসহ খুবই কমসংখ্যক যুবক-যুবতীকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। এর পরেই নাহিদের এক বছরের প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু হয় এবং তাঁকে বিশেষভাবে অসমের জন্য এই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
ইউনিসেফের যুব অধিবক্তা হিসেবে নাহিদ এখন অসমে বাল্যবিবাহের মতো সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন।
লন্ডনে প্রবাসীদের সাথে নাহিদ আফ্রিন
নাহিদ আফ্রিন আওয়াজ দ্য ভয়েসকে বলেন,"কন্যা সন্তানের কথা ভাবলে সাধারণত শিক্ষা,স্বাস্থ্য ও বিকাশের কথাই মাথায় আসে। এখন বাল্যবিবাহের পাশাপাশি আমি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা করেছি। কারণ আজকাল প্রায়ই দেখা যায়,বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী বা শিশুরা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের শিশুরা মানসিক চাপে ভোগে, কারণ তাদের পড়াশোনা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়।"
তিনি আরও বলেন,"পিতামাতার চাপ,সামাজিক চাপে ভুগতে ভুগতে অনেকেই তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে। ইউনিসেফ ইন্ডিয়ার যুব অধিবক্তা এবং মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে আমি এখন এই দিকটিতেই গুরুত্ব দিচ্ছি কীভাবে শিশুদের মানসিক চাপ থেকে মুক্ত করা যায়, তাদের বোঝানো যায় এবং সচেতনতা গড়ে তোলা যায়।"
মঞ্চে নাহিদ আফ্রিন
নাহিদের মতে, গ্রামীণ অঞ্চলে প্রায়ই দেখা যায় যে শিশুর জন্মের পর বাবা- মার মধ্যে সঠিক জ্ঞানের অভাবে শিশুর পুষ্টির বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নবজাতক জন্মের পর বুকের দুধ খাওয়ানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ—সেই বিষয়েও গ্রামের মানুষ অনেক সময় জানেন না। ইউনিসেফ ইন্ডিয়ার যুব অধিবক্তা হিসেবে এই বিষয়ে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নাহিদ সম্পূর্ণরূপে দায়বদ্ধ থাকবেন।
ভবিষ্যতে নিজের পরিচয় কীভাবে দিতে চান, এমন প্রশ্নে নাহিদ বলেন,"আমি সংগীত, শিক্ষা এবং সমাজসেবার ধারাকে অব্যাহত রাখব। ভগবান বা আল্লাহ আমাকে এখন পর্যন্ত অনেক আশীর্বাদ ও দয়া করেছেন। এক কথা আমি নিশ্চিত করতে চাই যে, ভবিষ্যতে আমি হই বা যাই কাজ করি, তা অবশ্যই সমাজের কল্যাণের জন্যই হবে। এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য একটি উন্নত স্থান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কিছু অবদান রেখে যাওয়া একজন ব্যক্তি হিসেবে আমি নিজেকে স্মরণ করতে চাই।"