বিহারের গয়া থেকে দুবাই পর্যন্ত সফর: নকশাল-পীড়িত গ্রামের শোয়েব খান এখন ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 1 d ago
বিহারের গয়া থেকে দুবাই যাত্রা: নকশাল-প্রভাবিত গ্রামের শোয়েব খান ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠলেন
বিহারের গয়া থেকে দুবাই যাত্রা: নকশাল-প্রভাবিত গ্রামের শোয়েব খান ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠলেন
 
নওশাদ আখতার / গয়া (বিহার)

বিহারের গয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছানোর গল্প আজ সবার অনুপ্রেরণা। নকশাল-পীড়িত মাটিতে জন্ম নিয়েও শোয়েব খান আজ দুবাই ও শারজাহর ঝলমলে স্টেডিয়ামে ছক্কা হাঁকাচ্ছেন। তাঁর প্রতিভা ও অধ্যবসায়ের ফলেই আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি দিল্লি ক্যাপিটালসের সহযোগী দল দুবাই ক্যাপিটালসের ডেভেলপমেন্ট টিমে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি, যা শুধু তাঁর পরিবারের নয়, গোটা বিহারের গর্ব।
 
বিহারের অতি নকশাল-পীড়িত এলাকা ইমামগঞ্জের কোঠি গ্রাম থেকে দুবাইয়ের ক্রিকেট ময়দানে নিজের পরিচয় গড়ে তোলা শোয়েবের সাহস, অধ্যবসায় ও সংগ্রামের কাহিনি। যে গ্রামে শিক্ষা ও খেলাধুলোর প্রাথমিক সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া কঠিন ছিল, সেখানকার এক শিশুই তার স্বপ্নকে ডানা মেলতে শিখিয়েছে।
 
শোয়েব আলী খানের ফেসবুক একাউন্টে স্ক্রিনশট 
 
শুরুতে সংগ্রাম ও পরিবারের সমর্থন
 
শোয়েবের বাবা, আদিব খান ওরফে জুগনু খান, একজন কৃষক ও সমাজকর্মী। নকশালবাদে ক্ষতবিক্ষত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও, তিনি সর্বদা শিক্ষাকে পরিবারের অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
 
নিজে এলএলবি ডিগ্রিধারী হওয়ায়, সন্তানদের ভালো শিক্ষা দিতে কোনো কসর রাখেননি। সেই সময় গ্রামে ভালো স্কুল না থাকায় তিনি শোয়েবের ভর্তি করান গয়া শহরের জ্ঞান ভারতী স্কুলে।
 
সেখান থেকেই শোয়েবের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ আরও গভীর হয়। শুরুতে বাবা-মা তাঁর কেরিয়ার নিয়ে আশঙ্কিত ছিলেন, কিন্তু শোয়েবের জেদ ও উত্সাহের কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে হয়।
 
শোয়েবের বড় ভাই, আলতমশ খান, যিনি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় HRVCA পদে কর্মরত, জানান যে স্কুল স্তরে খেলার পর শোয়েব জেলা ও রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতাতেও অংশ নিয়েছিল।
 
 
এই সময় তাঁর নির্বাচন হয় দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেট চালিয়ে যান। এখানে নিজের পারফরম্যান্সের জোরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় দলে জায়গা করে নেন এবং দেশের বহু বড় খেলোয়াড়ের সঙ্গে চ্যারিটি ম্যাচ ও ইউনিভার্সিটি ডেভেলপমেন্ট টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন।
 
রণজি দলে হতাশা আর দুবাইয়ে নতুন সুযোগ

শোয়েবের স্বপ্ন ছিল ভারতের হয়ে খেলা, কিন্তু বিহার রণজি দলে জায়গা না পাওয়ায় তিনি ভীষণভাবে হতাশ হয়েছিলেন। এক সময় তো তিনি ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন।
 
ঠিক তখনই দুবাইয়ে ক্রিকেট খেলার সুযোগের খবর আসে। শোয়েব তৎক্ষণাৎ সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন। তাঁর বাবা পুরোপুরি পাশে দাঁড়ান এবং মাসের পর মাস ঘর থেকে টাকা পাঠিয়ে সহায়তা করেন। ধীরে ধীরে শোয়েব দুবাই ও শারজাহর একাধিক ক্লাবে খেলতে শুরু করেন এবং একজন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে নিজের পরিচয় গড়ে তোলেন।
 
শোয়েবের পরিশ্রম সফল হয় এবং এখন তিনি দুবাই ইন্টারন্যাশনাল টিমের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। ক্লাব ক্রিকেটে ধারাবাহিক দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে তিনি ম্যাচ খেলার জন্য পারিশ্রমিকও পেতে শুরু করেন।
 
বিজয়ী কাপ হাতে শোয়েব খান 
 
দুবাইয়ের ক্রিকেট পিচ শোয়েবের স্বপ্নকে নতুন ডানা দিয়েছে। তাঁর দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ের জন্য এমিরেটস ক্রিকেট বোর্ড তাঁকে সম্মানিত করেছে। গত বছর তিনি প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ ও টুর্নামেন্টের সেরা ফিল্ডার পুরস্কারও পেয়েছেন।
 
দুবাই ক্যাপিটালসে দুর্দান্ত সূচনা
 
শোয়েব আই এল টি ২০ (ILT20) ডেভেলপমেন্ট লিগে দুবাই ক্যাপিটালসের হয়ে নিজের প্রথম ম্যাচেই অসাধারণ পারফরম্যান্স করেন। প্রথম ইনিংসে তিনি ৩টি ছক্কা ও ১টি বাউন্ডারির সাহায্যে ৩৫ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলেন, যা তাঁর দলকে ৫ রানে রোমাঞ্চকর জয় এনে দেয়।
 
এই পারফরম্যান্স শুধু দলকে প্রথম জয়ই দেয়নি, বরং শোয়েব তাঁর দলের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও হন। নকশাল-পীড়িত কোঠি গ্রামের এক খেলোয়াড়ের দুবাইয়ের ঝলমলে টি২০ লিগে এমন সাফল্য সত্যিই অবিশ্বাস্য। তাঁর এই কৃতিত্বের খবর গ্রামে পৌঁছাতেই উৎসবের আবহ তৈরি হয়।
 
শোয়েবের ভাই আলতমশ খান জানান, যদি শোয়েব আই এল টি ২০ ডেভেলপমেন্ট লিগে ভালো পারফরম্যান্স চালিয়ে যান, তবে তাঁর নাম এমিরেটস ক্রিকেট বোর্ডের (ECB) আন্তর্জাতিক আই এল টি ২০ ২০২৬ মৌসুমের নিলামে উঠবে।
 
শোয়েব খান
 
তাঁদের আশা, শোয়েব কোনো না কোনো দলে, হয়তো আবার দুবাই ক্যাপিটালসেই, জায়গা পাবেন। আলতমশ আরও বলেন, শোয়েবের স্বপ্ন একদিন আইপিএল খেলা, আর যদি তিনি এমিরেটস দলের হয়ে নির্বাচিত হন, তবে বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে আইপিএলে খেলার সুযোগও পেতে পারেন।
 
বাবা জুগনু খান: ছেলের প্রথম কোচ ও পথপ্রদর্শক
 
শোয়েব খানের সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান তাঁর বাবা জুগনু খানের ত্যাগ ও সমর্থন। নকশাল-পীড়িত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে বসবাস করেও, যেখানে ১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত নকশালীদের ঘটনাবলি ও নিরাপত্তাহীনতা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার, তিনি সন্তানের শিক্ষা ও স্বপ্নের সঙ্গে কখনোই আপস করেননি।
 
তিনি নিজেই জানান, নকশালদের ভয়ে কৃষিকাজও কঠিন হয়ে উঠেছিল। তবুও তিনি গয়াজি শহরে সন্তানদের হোস্টেলে রেখে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন।
 
জুগনু খান জানান, যখন শোয়েব গয়ার একটি বেসরকারি স্কুলে পড়ত, তখন ক্রিকেটের নেশা তাকে সহজ পথ বেছে নিতে দেয়নি। স্কুলের ছুটির সময় তিনি প্রতিদিন মোটরসাইকেল নিয়ে ছেলেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের গয়াজির গান্ধী ময়দানে প্র্যাকটিসের জন্য নিয়ে যেতেন।
 
ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়াশোনার সময়ও শোয়েবের প্র্যাকটিসের পুরো ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরে পরিবার নিজেদের গ্রাম্য জমিতে একটি পিচ তৈরি করায়, যেখানে শোয়েব নিয়মিত অনুশীলন করত।
 
শোয়েব খান তাঁর দলের সঙ্গে
 
মাত্র ৬ বছর বয়স থেকেই শোয়েব ক্রিকেট খেলা শুরু করে। তাঁর বাবার মতে, এই নেশা শৈশব থেকেই গভীরভাবে তাঁর মধ্যে ছিল। ১২ বছর বয়সেই শোয়েব নিজের গ্রাম কোঠিতে ‘কোঠি ক্লাব’-এর প্রতিষ্ঠা করে, যাতে গ্রামের ছেলেরা ক্রিকেটের আনন্দ উপভোগ করতে পারে। মাঠও তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন।
 
বাবা জুগনু খান বলেন, “ভারতে ক্রিকেট নিয়ে এক ভিন্ন মাত্রার উন্মাদনা রয়েছে, কিন্তু খেলোয়াড়দের ভিড় এত বেশি যে একটি পিছিয়ে পড়া গ্রাম থেকে জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া ভীষণ কঠিন। বিহার রণজি টিমের একাধিক ক্যাম্পে শোয়েবের নির্বাচন হলেও মূল ম্যাচে সুযোগ মেলেনি। দুবাইয়ের সুযোগটাই শোয়েবের জন্য সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।”
 
শোয়েব খানের এই গল্প শুধু একজন খেলোয়াড়ের সাফল্যের কাহিনি নয়, বরং এটি এক পরিবারের সংগ্রাম, এক বাবার ত্যাগ আর একটি ছোট গ্রামের বড় স্বপ্নের গল্পও বটে।
 
শোয়েব আজ দুবাইয়ের সবুজ পিচে যখন ব্যাট চালান, তখন তাঁর প্রতিটি শটের সঙ্গে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত গর্বের স্রোত বয়ে যায়। তাঁর এই পথচলা প্রমাণ করেছে যে প্রতিকূল পরিস্থিতি ও সীমিত সুযোগ-সুবিধার মাঝেও যদি অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায় থাকে, তবে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব। শোয়েবের সাফল্য আজ অসংখ্য তরুণের কাছে আশা ও অনুপ্রেরণার নতুন দিশা হয়ে উঠেছে।