ইসলাম ধর্মপ্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ শান্তির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক: কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 23 h ago
বেঙ্গালুরুর ঐতিহাসিক প্যালেস গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত 'জেসন-ই-মিলাদুন্নবী' সম্মেলনের একটি দৃশ্য।
বেঙ্গালুরুর ঐতিহাসিক প্যালেস গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত 'জেসন-ই-মিলাদুন্নবী' সম্মেলনের একটি দৃশ্য।
 
সবিহা ফাতিমা / বেঙ্গালুরু

বেঙ্গালুরুর ঐতিহাসিক প্যালেস গ্রাউন্ডে গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত ‘জশন-ই-মিলাদুন্নবী’ সম্মেলন এক অনন্য আধ্যাত্মিক ও সামাজিক সমাবেশে পরিণত হয়েছিল। দেশজুড়ে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান শুধু ধর্মীয় উদ্‌যাপনই নয়, বরং শান্তি, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে সাংবিধানিক মূল্যবোধকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিল।
 
যৌথ মিলাদ সমিতির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে জুলুস-ই-মহম্মদী কমিটি বেঙ্গালুরু, সর্বকর্ণাটক মিলাদ ও জুলুস রহমাতুল লিল আলমিন সমিতি এবং সর্বকর্ণাটক সুন্নী জমিয়াতুল উলেমা প্রভৃতি সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। এ উপলক্ষে কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া সভায় ভাষণ দিয়ে শান্তি, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক চেতনাকে গ্রহণ করার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান।
 
তিনি বলেন, হজরত মুহাম্মদের জীবন মানবতাকে ন্যায়, সমতা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির পথে পরিচালিত করে, আর এগুলোই ভারতের সংবিধানে নিহিত মৌলিক উপাদান। নবীর শিক্ষাকে কর্ণাটকের সামাজিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করে মুখ্যমন্ত্রী বাসবন্নার শরণ আন্দোলনের উদাহরণ টেনে ধরেন। তিনি বলেন, বাসবন্না যেমন সমাজে সমতা ও মমতার বার্তা প্রচার করেছিলেন, ঠিক তেমনি হজরত মুহাম্মদ মানবতাকে ভ্রাতৃত্ববোধ ও দয়ার পথ দেখিয়েছিলেন।
 
নবী মুহাম্মদের ১৫০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময় কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া

তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, ইসলামের প্রকৃত অর্থ শান্তি এবং নবী বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তির দূত। ভারতীয় সংবিধানও এই আদর্শের ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে এবং এর মূল মন্ত্র হল সমতা, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ। সংবিধানকে কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে দৈনন্দিন জীবনে কার্যকর করতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “জয় হিন্দ, জয় কর্ণাটক, জয় হিন্দু-মুসলমান।”
 
উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমারও সম্মেলনে ভাষণ দিয়ে বলেন, হজরত মুহাম্মদ সমাজের নিপীড়িত ও অসহায় শ্রেণির জন্য কণ্ঠস্বর তুলে সমতার ভিত গড়ে তুলেছিলেন। প্রতিটি ধর্মই শান্তির শিক্ষা দেয় এবং প্রতিটি প্রার্থনা একই ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে করা হয়। কোনো ধর্মই অন্যের দুঃখ-কষ্টের কারণ হতে শেখায় না। নবীর শিক্ষা অনুযায়ী আমাদের দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষা করা উচিত।
 
শিবকুমার মুসলমানদের উৎসাহ দিয়ে বলেন, চিকিৎসক, পেশাজীবী, নেতা এবং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ার পরও নিজেদের সংখ্যালঘু মনে করার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, আমাদের একসঙ্গে ভারতের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিতে হবে।
 
সম্মেলনে ধর্মীয় পণ্ডিত ও উলামাগণও নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেন। কলকাতার মুফতি সাজ্জাদ আলম স্মরণ করিয়ে দেন যে, মসজিদ-ই-নববীতে একদল ইবাদতে লিপ্ত থাকলেও অপরদল জ্ঞান আহরণ করত। তিনি বলেন, আজকের সমস্যার সমাধান হজরত মুহাম্মদের চরিত্রের মধ্যেই নিহিত, আর মানবতার সমস্যার উত্তর কেবল জ্ঞান, করুণা ও শান্তির সমন্বয়ের মাধ্যমেই সম্ভব।
 
কেরালার পণ্ডিত ইব্রাহিম খলিল থাঙ্গল মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়াকে প্রশংসা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আদর্শ আখ্যা দেন এবং বলেন, কর্ণাটকে শান্তিপূর্ণভাবে এই বিশাল সম্মেলনের আয়োজন পুরো দেশের জন্যই একটি বার্তা স্বরূপ।
 
হজরত আল্লামা পীর সৈয়দ মুহাম্মদ খাসিম আশরাফ বাবা ভাষণে বলেন, নবী পতিতদের উন্নীত করেছিলেন, ভগ্ন হৃদয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং মানুষকে বাঁচার কলা শিখিয়েছিলেন। ধন-সম্পদ ও ক্ষমতা অন্যের কাজে না লাগলে তার কোনো মূল্য নেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং নবীর শিক্ষা যেমন পানির অপচয় না করার মতো ছোট অথচ গভীর শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে পরিবেশ ও সম্পদ সংরক্ষণের পথ দেখিয়েছে।
 
নবী মুহাম্মদের ১৫০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক সম্মেলনে কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া 
 
ড. আব্দুল হাকিম আজহারী বলেন, নবীর অতুলনীয় চরিত্রই ছিল এমন, যার ফলে তাঁকে হত্যার জন্য আসা লোকেরাই তাঁর অনুগামী ও প্রশংসক হয়ে পড়েছিল। এটাই ছিল তাঁর মমতা ও শান্তির প্রকৃত শক্তি।
 
জামা মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল কাদির নাত-খাওয়ানির গুরুত্বের প্রসঙ্গে বলেন, আল্লাহ তাঁর প্রিয়জনকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন এবং তাঁর প্রশংসাকারীদেরও সম্মান দিয়েছেন। প্রতিটি নাতের বার্তাই হল প্রেম, করুণা ও শান্তি।
 
অনুষ্ঠানে পুলিশ কমিশনার সীমান্ত কুমার সিং ও বলেন, এইবার হজরত মুহাম্মদের জন্মের ১৫০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সবাইকে শান্তির দূত হয়ে সমাজে শান্তির বার্তা প্রচার করতে হবে।
 
সম্মেলনের মন্ত্রী ও পৃষ্ঠপোষক বিজেড জামির আহমেদ খান বিনম্রতা প্রদর্শন করে জানান, তিনি মঞ্চে বসে ভাষণ দেবেন না বরং সাধারণ মানুষের সঙ্গে বসে শ্রবণ করবেন।
 
সম্মেলনের পরিবেশ ছিল আধ্যাত্মিকতা ও উৎসাহে ভরা। নাত-খাওয়ান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন, মুহাম্মদ জুনায়েদ আশরাফী কলিকাতাবী ও মুহাম্মদ বাকর নবীর প্রশংসায় কলিমা পাঠ করেন, যার কণ্ঠে পুরো পরিবেশ প্রেম ও আধ্যাত্মিকতায় ভরে ওঠে। এ উপলক্ষে SYS অ্যাম্বুলেন্স সেবারও সূচনা হয়, যা সমাজসেবার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
 
এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া, উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার, মন্ত্রী বিজে জামির আহমেদ খান, মন্ত্রী কে জে জর্জ, বিধায়ক এন এ হ্যারিস, মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব নাসির আহমেদ খানসহ বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মগুরু ও পণ্ডিতরাও উপস্থিত ছিলেন। উসমান শরীফ ও জি এ বাভার মতো সমাজের নেতারা অনুষ্ঠানের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
 
সম্মেলনের সবচেয়ে বড় বার্তা ছিল যে, হজরত মুহাম্মদের শিক্ষা এবং ভারতীয় সংবিধান দুটোই সমতা, ন্যায় ও ভ্রাতৃত্ববোধের কথা বলে। সংবিধানকে কেবল বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জীবন ও কর্মে কার্যকর করা নাগরিকের কর্তব্য। আমরা যদি এটি না করি, তবে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র ও মানবতাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
 
নবী মুহাম্মদের জীবনী নিয়ে আয়োজিত একটি সম্মেলনের একটি দৃশ্য 

সম্মিলিত প্রার্থনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে, যেখানে সমগ্র দেশ ও বিশ্বের শান্তি, অগ্রগতি ও সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা করা হয়। প্রতিটি বক্তাই আবারও উল্লেখ করেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, নবী শান্তির দূত। ভারতের ভবিষ্যৎ তখনই সুরক্ষিত হবে, যখন আমরা সমাজে ঐক্য, সহনশীলতা ও পারস্পরিক সম্মান গ্রহণ করব।
 
পুরো সম্মেলনটি ছিল আল্লামা ইকবালের সেই বিখ্যাত শায়েরির প্রতিধ্বনি স্বরূপ, “কি মুহাম্মদ সে ওফা তুনে তো হাম তেরে হ্যায়। ইয়ে জহাঁ চীজ হ্যায় ক্যা। লওহ-ও-কলম তেরে হ্যায়।” এই শায়েরিটি সম্মেলনের আত্মার মতো প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এবং হাজার হাজার মানুষকে প্রেম, আনুগত্য ও শান্তির উষ্ণ বার্তার সঙ্গে যুক্ত করেছিল।
 
বেঙ্গালুরুর এই সম্মেলন ধর্মীয় উদ্‌যাপনের সীমা অতিক্রম করে সমাজে ভ্রাতৃত্ব, সহনশীলতা এবং সাংবিধানিক দায়িত্ববোধের এক বিরল উদাহরণ হয়ে উঠেছিল। নবীর শিক্ষা আজও যেমন মানবতার পথপ্রদর্শক, তেমনি এই অনুষ্ঠানের বার্তাও ছিল, শান্তি, ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে আমরা যদি একসঙ্গে এগিয়ে যাই, তবে ভবিষ্যতের ভারত হবে আরও শক্তিশালী, সমৃদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধ।