ওয়াকিফা বেগম: বরাক উপত্যকার কিশোরী ক্যারাটে চ্যাম্পিয়ন, সমাজের বাঁধা ভেঙে গড়ল নতুন দৃষ্টান্ত

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 2 d ago
অল ইন্ডিয়া ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পদক জয়ী ওয়াকিফা বেগম
অল ইন্ডিয়া ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পদক জয়ী ওয়াকিফা বেগম
 
অপর্ণা দাস / গুয়াহাটি

অসমের বরাক উপত্যকা, যেখানে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি অনন্য সমাজ, আজ সেখানে উঠে আসছে নতুন এক নক্ষত্র। বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে খেলাধুলা বা মার্শাল আর্টে অংশগ্রহণ এখনও সমাজের অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু কাটিগড়ার তরুণী ওয়াকিফা বেগম সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে জাতীয় স্তরে সফলতা অর্জন করে হয়ে উঠেছেন এক  নতুন প্রেরণার উদাহরণ। তার গল্প এমন এক যাত্রা, যেখানে কঠোর পরিশ্রম, পরিবারিক সমর্থন ও অটুট সংকল্প একত্রে গড়ে তুলেছে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সূচনা।
 
বরাক উপত্যকার  এই কিশোরী মেয়েটির সাফল্যে আজ উচ্ছ্বসিত গোটা অঞ্চল। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পদক জয় করে নিয়েছেন। দশম শ্রেণির ছাত্রী ওয়াকিফার এই সাফল্য আজ গোটা কাছাড় জেলার পাশাপাশি অসমবাসীর কাছে গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছে।
 
'অল ইন্ডিয়া ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপ'- এর মঞ্চে ওয়াকিফা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে
 
ওয়াকিফার বাবা জামির হুসেন অসম পুলিশের একজন সদস্য, আর মা ইভেনথি কাইনাও নার্স হিসেবে কর্মরত। ছোটবেলা থেকেই মা তাঁর পাশে থেকে উৎসাহ যোগাতেন, যার প্রেরণায় ওয়াকিফার মধ্যে মার্শাল আর্টের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। শুরুতে তিনি বদরপুরের বিবেকানন্দ স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ক্যারাটে প্রশিক্ষণ নিতেন। সেখানেই শিলচরে অনুষ্ঠিত জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় রৌপ্য পদক অর্জনের প্রথম সাফল্য লাভ করেন। তবে পরে করোনাকালীন সময়ে প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়ে যায়।
 
২০২১ সালে আইডিয়াল পাবলিক সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ওয়াকিফা নতুন উদ্যমে তার স্বপ্ন পূরণের পথ পুনরায় শুরু করেন। স্কুলের আওতায় ‘সহানওয়াজ ফ্লাইং ফিট অ্যাকাডেমি’র ক্লাসে যোগ দিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি তার লক্ষ্যপানে দৃঢ় হয়ে এগিয়ে যান।

দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলস্বরূপ ২০২৫ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় প্রতিযোগিতায় তাঁর ঝুলিতে আসে ব্রোঞ্জ পদক। ফাইনাল ম্যাচে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বেঙ্গালুরু থেকে আগত এক প্রতিযোগী। একজন মুসলিম কিশোরী হিসেবে সমাজের চোখ রাঙানি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, ওয়াকিফা বলেন, “আমার মা সবসময় পাশে থেকেছেন। তাঁর সমর্থন ছাড়া আমি এতদূর আসতে পারতাম না। আমার পরিবার, কোচ ও স্কুলও আমাকে সমানভাবে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।” 
 
ওয়াকিফার কোচ সহানওয়াজ আহমেদ জানান, “ওয়াকিফা অত্যন্ত প্রতিভাবান ও পরিশ্রমী ছাত্রী। খুব ছোটবেলা থেকেই ওর মধ্যে শৃঙ্খলা ও দৃঢ় সংকল্প ছিল। মেয়েদের মধ্যে এমন মানসিকতা খুব কম দেখা যায়। নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সমর্থন পেলে সে আন্তর্জাতিক স্তরে বড় সাফল্য আনতে পারবে।”
 
জয়ী সার্টিফিকেট হাতে ওয়াকিফার একটি ছবি 
 
আইডিয়াল পাবলিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, “আমরা গর্বিত যে আমাদের এক ছাত্রী জাতীয় স্তরে পদক জয় করেছে। স্কুল থেকে আমরা সর্বদা তাকে সহযোগিতা করে এসেছি। আশা করি ভবিষ্যতে আরও অনেক মেয়েকে সে অনুপ্রাণিত করবে।”
 
বর্তমানে ওয়াকিফা পার্পল বেল্টধারী  ক্যারাটেকা। শুধু ক্যারাটে নয়, ওয়াকিফা একজন চমৎকার নৃত্যশিল্পীও। নাচের মাধ্যমে তিনি সাংস্কৃতিক দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচে তাঁর প্রতিভা বরাবরই সবার নজর কেড়েছে। কিন্তু নাচের পাশাপাশি মার্শাল আর্টকেও তিনি নিজের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিয়েছেন।  নাচের প্রতিভা তাঁর সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সমৃদ্ধ করেছে, আর ক্যারাটে তাঁকে পরিচিত করেছে শৃঙ্খলা ও শক্তির দুনিয়ায়। 
 
বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওয়াকিফার মার্শাল আর্ট প্রদর্শনের একটি মুহূর্ত
 
ভবিষ্যতে আরও ভালো করার লক্ষ্যে তিনি প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে চান।
 
ওয়াকিফার মতো কিশোরীরা দেখিয়ে দিচ্ছে, ইচ্ছা থাকলে পরিবার ও সমাজের সহায়তায় যে কোনো বাধাই পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। আজ ওয়াকিফা শুধু কাটিগড়ার নয়, গোটা কাছাড় জেলার গর্ব।