আম্না ফারুক
ভারতীয় ক্রীড়ার জন্য ২০২৫ সালটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ এই বছরে বিশেষ করে দলগত প্রতিযোগিতায় ভারতের সাফল্য ক্রীড়াক্ষেত্রে নতুন উদ্দীপনা ও আবেগ সৃষ্টি করেছে। এই বছরে উত্থান–পতন ও নানা বিতর্কের মাঝেও কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য ও মাইলফলক দেশবাসীকে গর্বের সঙ্গে উদযাপন করতে অনুপ্রাণিত করেছে। ক্রিকেট, অ্যাথলেটিক্স, দাবা, কাবাডি ও হকির পাশাপাশি স্কোয়াশও ২০২৫ সালে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
বিশ্ব মঞ্চে ঐতিহাসিক জয় থেকে শুরু করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করা ব্যক্তিগত মাইলফলক পর্যন্ত—এই বছরটি বিভিন্ন ক্রীড়ায় দেশের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও ধারাবাহিক অগ্রগতির প্রমাণ তুলে ধরেছে। প্রশাসনিক স্তরেও ভারতের প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়ে দেশটি ২০৩০ সালের কমনওয়েলথ গেমসের আয়োজক হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বলা যায়, ২০২৫ সালটি ক্রীড়া জগতের জন্য মোটেই হতাশাজনক ছিল না।

ভারতীয় খেলোয়াড়
ক্রিকেটে পুরুষ হোক বা মহিলা—সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভারতের বিজয়পতাকা উড়িয়েছেন। এর ফলে ব্লাইন্ড ক্রিকেটেও ভারতের আধিপত্য স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
২০২৫ সালে ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল তৃতীয়বারের মতো আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয় করে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টে ভারতীয় দল অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখায়। রোহিত শর্মার নেতৃত্বে দলটি গ্রুপ পর্বে অপরাজিত থেকে শক্ত অবস্থান তৈরি করে এবং দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে চার উইকেটে পরাজিত করে।
বাংলাদেশ ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দৃষ্টিনন্দন জয়ে ভরপুর ছিল ভারতের এই যাত্রা, যা সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তাদের আধিপত্যকে আরও শক্তিশালী করেছে। এটি ছিল ভারতের তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শিরোপা। এর আগে ভারত ২০০২ ও ২০১৩ সালে এই খেতাব জিতেছিল।
এই প্রতিযোগিতায় ভারত একাধিক মাইলফলকও অর্জন করে। বিরাট কোহলি দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে ১৪,০০০ একদিনের আন্তর্জাতিক রান পূর্ণ করেন। মহম্মদ শামি ২০০টি ওয়ানডে উইকেট সম্পূর্ণ করেন এবং রোহিত শর্মা আইসিসি একদিনের ইভেন্টে সর্বাধিক ছক্কা মারার রেকর্ড গড়েন।

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি
২০২৫ সালে টিম ইন্ডিয়ার দ্বিতীয় বড় সাফল্য ছিল এশিয়া কাপ জয়। এশিয়া কাপ ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত হয়। ফাইনালে ভারত পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে পরাজিত করে নবমবারের মতো খেতাব জিতেছে।
ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল ২০২৫ সালে প্রথমবারের মতো আইসিসি মহিলা বিশ্বকাপ জয় করে। এটি ভারতীয় মহিলা ক্রীড়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। অবশ্য এই সাফল্য রাতারাতি আসে নি; এটি মহিলা ক্রিকেটের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম এবং কঠোর পরিশ্রমের ফল। এই কৃতিত্ব শুধুই একটি ট্রফি নয়, বরং মহিলা ক্রিকেটে দশকের পরিশ্রমের স্বীকৃতি।
প্রতিযোগিতা ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। নবী মুম্বাইয়ের ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে ফাইনালে হরমনপ্রীত কৌরের নেতৃত্বে ভারত দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫২ রানে পরাজিত করে। লীগ পর্যায়ে ভারত চতুর্থ স্থান অর্জন করলেও নকআউট রাউন্ডে চমকপ্রদ পারফরম্যান্স দেখিয়ে ফাইনালে প্রবেশ করে এবং সেমি-ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করে।
ভারতের ঐতিহাসিক জয়ের পর ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ বোর্ড দলটিকে ৫১ কোটি টাকার নগদ পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৩৯.৭৮ কোটি টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে। ফলে ভারতীয় মহিলা দল মোট ১২৩ কোটি টাকার পুরস্কার লাভ করে।

হকিতে হিরো: এশিয়া কাপ জয়ের পর ভারতীয় দল
ভারতের ক্রিকেট দল প্রথমবারের মতো ব্লাইন্ড উইমেন্স টি-২০ বিশ্বকাপ জয়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্লাইন্ড ক্রিকেটেও বড় সাফল্য অর্জন করে। এই প্রতিযোগিতায় ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের দলগুলো অংশ নেয়। প্রথমবার দৃষ্টিশক্তিহীন খেলোয়াড়দের জন্য অনুষ্ঠিত ব্লাইন্ড উইমেন্স টি-২০ বিশ্বকাপে ভারত ফাইনালে নেপালকে পরাজিত করে অপারাজিত চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পুরো টুর্নামেন্টে ভারত শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া এবং পাকিস্তানকেও পরাস্ত করে।
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, ভারতীয় হকি দল ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৪-১ গোল ব্যবধানে পরাজিত করে এশিয়া কাপ জয় করে। এই জয় হকি প্রেমীদের দীর্ঘদিনের সফলতা উদযাপনের সুযোগ এনে দেয়। ৮ বছরের বিরতির পর এশিয়া কাপের খেতাব ভারতকে ফিরে আসে এবং দলটি পরবর্তী বিশ্বকাপের জন্য যোগ্যতা অর্জন করে। প্রতিযোগিতা আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বিহারের রাজগীর শহরে অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজক হিসাবে ভারত গ্রুপ পর্বে অপরাজিত থাকে এবং ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়াকে পরাজিত করে খেতাব জিততে সক্ষম হয়। সুপার ফোর পর্বে ভারতীয় যুব ও অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা অধিনায়ক হরমনপ্রীত সিং-এর নেতৃত্বে চমকপ্রদ পারফরম্যান্স দেখায়। এই জয় বিগত কয়েক বছরের দুর্বলতার পর একটি প্রত্যাবর্তন হিসেবে ধরা হয়, যা উন্নত কৌশল এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষাকে তুলে ধরে।
জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লিতে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত দ্বাদশবারের মতো অনুষ্ঠিত বিশ্ব পেরা এটলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ভারত প্রথমবারের মতো শীর্ষস্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়। আয়োজক ভারত দশম স্থান অর্জন করে ইতিহাসের সেরা পারফরম্যান্স প্রদর্শন করে। ভারতের মোট পদক সংখ্যা ২২: ৬টি স্বর্ণ, ৯টি রূপা এবং ৭টি ব্রোঞ্জ। এর আগে ২০২৪ সালে জাপানের কোবেতে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নশিপে ভারত ১৭টি পদক অর্জন করেছিল।ভারতীয় দলটিতে ৭৩ জন খেলোয়াড় ছিল, যার মধ্যে ৫৪ জন পুরুষ এবং ১৯ জন মহিলা। এই চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতীয় খেলোয়াড়রা ৩টি চ্যাম্পিয়নশিপ রেকর্ড, ৭টি এশিয়ান রেকর্ড এবং ৩০টিরও বেশি ব্যক্তিগত সেরা পারফরম্যান্স তৈরি করে। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় ১০৪টি দেশ থেকে ২০০০-এরও বেশি খেলোয়াড় অংশ নেয়।

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী অন্ধ মহিলা দল
ক্রিকেট থেকে হকি পর্যন্ত, টিম ইন্ডিয়ার পক্ষে ভারত বিজয় পতাকা উড়াতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে, ভারতীয় খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত সাফল্য এবং কৃতিত্বের একটি দীর্ঘ তালিকাও রয়েছে। প্রথমে জেবলিনের ক্ষেত্রে নীরজ চোপড়ার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, যিনি ৯০ মিটারেরও বেশি দূরত্বে থ্রো করে এক মাইল দূরত্বের খুঁটি স্থাপন করেছিলেন। তার এই কৃতিত্বই ভারতের অ্যাথলেটিকস ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। একইভাবে দাবা খেলে ডি গুকেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে একটি বড় সাফল্য অর্জন করেন। শুটিং-এ মনু ভাকে রাষ্ট্রীয় ক্রীড়া পুরস্কার লাভ করেন। সম্রাট রানা ১০ মিটার এয়ার পিস্টল ইভেন্টে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন।
আর্চারিতে জ্যোতি সুরেখা ভেন্নম বিশ্বকাপের ফাইনালে পদক জয় করা প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে পরিচিত হন। তিনি কম্পাউন্ড আর্চারিতে ব্রোঞ্জ পদক জিতে ইতিহাস রচনা করেন। ২০২৫ সালটি ভারতীয় ক্রীড়ার জন্য একটি নতুন বছর হিসেবে পরিচিত হয়। এই সাফল্যগুলো সাহস, উদ্ভাবন এবং সামूहিক আনন্দের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ২০২৬ সালের জন্য যে ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে, তা আরও বড় সাফল্যের আশা জাগাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে নতুন বছরটি আরও পদক, খেতাব এবং স্মরণীয় কাহিনী নিয়ে আসবে।