মিসেস ইয়াসমিনের পাঠ: একটি শ্রেণিকক্ষে যেভাবে রঙিন হয়ে উঠেছিল ধর্মের সহাবস্থান

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 6 h ago
চুরা, সিঁদুর এবং মঙ্গলসূত্র পরা একজন মুসলিম ইংরেজি শিক্ষকের ছবি (AI- জেনারেটেড)
চুরা, সিঁদুর এবং মঙ্গলসূত্র পরা একজন মুসলিম ইংরেজি শিক্ষকের ছবি (AI- জেনারেটেড)
 
বিদুষী গৌর

লখনউয়ের লরেটো কনভেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজ আমার জীবনের শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না; সেখানেই প্রথম বুঝেছিলাম, ভিন্নতা মানেই বিভাজন নয়। সেই স্কুলই আমাকে দেখিয়েছিল, ভারতের বহুত্ব কীভাবে নীরবে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে একসঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে, কোনো দেয়াল না তুলে, কোনো দূরত্ব না বানিয়েই। 
 
একটি স্মৃতি আজও আমার সঙ্গে থেকে গেছে, উষ্ণ, রঙিন, আর নীরব অথচ গভীর। সেই স্মৃতির কেন্দ্রবিন্দু আমার ইংরেজির শিক্ষিকা, মিসেস ইয়াসমিন। তিনি আমাকে শুধু ব্যাকরণ, অনুধাবন বা শেক্সপিয়ার শেখাননি, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু শিখিয়েছিলেন।

Unforgettable Experiences

তিনি আমাকে এমন এক শিক্ষা দিয়েছিলেন, যা পাঠ্যবইয়ের কোনো অধ্যায়েই লেখা ছিল না। তখন তার মানে বোঝার মতো বয়স আমার ছিল না, কিন্তু আজ স্পষ্ট বুঝি, সেটা ছিল সম্প্রীতির পাঠ। লরেটো কনভেন্ট ছিল একটি ক্যাথলিক স্কুল। সকালের প্রার্থনায় ভেসে আসত স্তোত্রসংগীতের কোমল সুর, দেওয়ালে ঝুলত মাদার মেরির ছবি, আর স্নেহমিশ্রিত শাসনে শিক্ষিকারা এমন এক পরিবেশ গড়ে তুলতেন, যেখানে শৃঙ্খলা কখনোই কঠোর মনে হতো না। 
 
চুরা, সিঁদুর এবং মঙ্গলসূত্র পরা একজন মুসলিম ইংরেজি শিক্ষকের ছবি (AI- জেনারেটেড)
 
হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, সব ধর্মের মেয়েরা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে একই সুরে গান গাইতাম, প্রার্থনায় মাথা নত করতাম। তখন এটাকে খুব স্বাভাবিক মনে হতো, কিন্তু আজ বুঝি, সেই স্বাভাবিকতার মধ্যেই ছিল অসাধারণত্ব।
 
ক্লাস সেভেনে আমার জীবনে এলেন মিসেস ইয়াসমিন, লম্বা, স্নিগ্ধ, আর এমন এক কণ্ঠস্বর, যা সবচেয়ে নিরস কবিতাকেও যেন গোপন কথা করে তুলত। তিনি মুসলিম ছিলেন, আর তাঁর বিয়ের খবর পুরো স্কুলেই ছড়িয়ে পড়েছিল। সপ্তাহের পর সপ্তাহ স্টাফরুম ভরে ছিল অভিনন্দন আর প্রশংসায়।
 
তিনি ঐতিহ্যবাহী মুসলিম রীতিতেই বিয়ে করেছিলেন, ঝলমলে দুপাট্টার নিচে নিকাহ, হাতে সুন্দর মেহেন্দি। তাঁর বিয়ের ছবি আমরা দেখেছিলাম, একজন লখনউয়ের কনের মতোই তিনি ছিলেন দীপ্ত, মার্জিত, অনিন্দ্যসুন্দর।
 
কিন্তু বিয়ের পর যা ঘটেছিল, সেটাই আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে।
 
বিয়ের ছুটি শেষে এক সপ্তাহ পর তিনি স্কুলে ফিরলেন। আমি তখন দ্বিতীয় বেঞ্চে বসে পা দোলাচ্ছিলাম। হঠাৎ তাঁকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে চোখ আটকে গেল। তাঁর সিঁথিতে উজ্জ্বল লাল সিঁদুর, হাতার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল-সাদা চুড়ি, আর হালকা রঙের কুর্তার ওপর শান্তভাবে ঝুলছে একটি মঙ্গলসূত্র।
 
মুহূর্তটিতে পুরো ক্লাস যেন একসঙ্গে চোখ পিটপিট করল। বাতাসে ভাসছিল এক নরম বিস্ময়। আমরা তখন ধর্মীয় সীমারেখা বোঝার মতো বড় হইনি, কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে, এটা বুঝবার মতো বয়স হয়েছিল। শেষমেশ এক সাহসী মেয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,
“ম্যাডাম… আপনি… পরেছেন…?”
 
তিনি জীবনের সবচেয়ে সদয় হাসিটা হাসলেন। মঙ্গলসূত্রে হালকা করে হাত রেখে বললেন, “হ্যাঁ। আমি এগুলো পরেছি, কারণ হিন্দু কনেদের সাজ আমাকে খুব সুন্দর লাগে। রংগুলো, আনন্দটা… সবসময়ই ভালো লাগত।”
 
তাঁর কণ্ঠে কোনো দ্বিধা ছিল না, কোনো ব্যাখ্যার চাপও না, শুধু স্নেহ। সেদিন তিনি আমাদের জুলিয়েটের ব্যালকনি দৃশ্য পড়িয়েছিলেন, কিন্তু আসল পাঠটা ছিল অন্য জায়গায়। তিনি মুসলিম রীতিতেই বিয়ে করেছিলেন, নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য মেনেই। তবু অন্য এক ধর্মের সৌন্দর্যকে ভালোবেসে গ্রহণ করেছিলেন, বিদ্রোহে নয়, ভালোবাসায়। সেই সরলতা আর সাহসের মধ্যে ছিল গভীর শক্তি।
 
একটি ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠানে, এক মুসলিম নারী হিন্দু কনের সাজে, আর কেউ তাঁকে থামায়নি, প্রশ্ন করেনি, বিচারও করেনি। লরেটোর সিস্টাররা নন, সহশিক্ষিকারা নন, ছাত্রীরাও না। আজও মনে আছে, করিডরে সিস্টার অ্যান তাঁকে দেখে বলেছিলেন, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে প্রিয়।” সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, লরেটো নিজেই যেন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছে।
 
চুরা, সিঁদুর এবং মঙ্গলসূত্র পরা একজন মুসলিম কনের ছবি (AI- জেনারেটেড)
 
মাসের পর মাস তাঁর সেই বিবাহচিহ্নগুলো থেকে গেল। প্রতিদিন নয়, যখন তাঁর ইচ্ছে হতো। কোনো দিন স্বাভাবিক সাজে ক্লাসে ঢুকতেন, কোনো দিন আবার সিঁদুরের ছোট্ট ফোঁটা বা লাল চুড়ি, যা বইয়ের পাতা উল্টানোর সময় মৃদু শব্দ করত।
 
আমার কাছে সেগুলো গয়না নয়, ছিল প্রতীক। পছন্দের, স্বাধীনতার, আর সৌন্দর্যের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ম্যাডাম, কেউ কিছু মনে করে না?” তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন,
“ভালোবাসা ছোট হলে মানুষ আপত্তি করে। কিন্তু ভালোবাসা বড় হলে সব কিছুর জন্য জায়গা থাকে।” তিনি মানুষে মানুষে ভালোবাসার কথা বলছিলেন, না কি সমাজের মধ্যে, না কি সৌন্দর্যের প্রতি, জানি না। কিন্তু সেদিন আমার ভেতরে কিছু একটা বদলে গিয়েছিল।
 
বছর পেরিয়ে গেছে। আজ যখন পোশাক, ধর্ম, পরিচয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক দেখি, আমি ফিরে যাই সেই ছবিটায়, ক্লাসের সামনে চক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক শিক্ষিকা, হাতে লাল চুড়ি, সীমারেখায় একেবারেই অচিন্তিত। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, পরিচয় ভঙ্গুর নয়। অন্য সংস্কৃতির রঙে ছুঁলে তা ভেঙে যায় না, বরং আরও সমৃদ্ধ হয়।
 
লরেটো কনভেন্ট আমাকে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান আর শৃঙ্খলা শিখিয়েছে। কিন্তু মিসেস ইয়াসমিন আমাকে শিখিয়েছেন, পরিচয়গুলো কী সুন্দরভাবে মিশে যেতে পারে। তিনি শিখিয়েছেন, ধর্মে নয়, সংঘাত হয় মানুষের মধ্যে। আর কখনও কখনও একজন মানুষই দেখিয়ে দিতে পারেন, কীভাবে আলতো করে দুই দুনিয়া একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়, কীভাবে কোরানের আয়াতের পাশে শান্তভাবে থাকতে পারে সিঁদুরের লাল দাগ, আর সকালের স্তোত্রের মাঝে মৃদু ঝনঝন করে বাজতে পারে চুড়ি।
 
আজও কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দেখতে কেমন, আমি কোনো বই বা ভাষণ উদ্ধৃত করি না। আমি শুধু আমার ইংরেজির শিক্ষিকাকে মনে করি, একজন মুসলিম নারী, একটি ক্যাথলিক স্কুলে, হিন্দু কনের সাজে, দৃপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আমাদের শুধু সাহিত্য নয়, সহাবস্থানের সবচেয়ে রঙিন পাঠটি শিখিয়ে দিচ্ছেন।
 
(পাঠকদের কাছে অনুরোধ: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা আন্তধর্মীয় বন্ধুত্বের নিজের অভিজ্ঞতা পাঠাতে পারেন [email protected] ই-মেলে—প্রকাশের জন্য। - সম্পাদক)