BBCI-এর নতুন সাফল্য; উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রথমবার MUD স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টের নেতৃত্বে ড. আসিফ ইকবাল
আরিফুল ইসলাম ও সুদীপ শর্মা চৌধুরী / গুয়াহাটি
উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্যান্সার চিকিৎসায় এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করল গুয়াহাটির ড. বি বরুয়া ক্যান্সার ইনস্টিটিউট (বিবিসিআই)। মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের অধিভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি পরিবারের বাইরের দাতার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ম্যাচড আনরিলেটেড ডোনার (এমইউডি) অ্যালোজেনিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট সফলভাবে সম্পন্ন করে চিকিৎসা ইতিহাসে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই সাফল্যের মাধ্যমে শুধু একটি তরুণ প্রাণই রক্ষা পেল না, বরং উত্তর-পূর্বে জটিল ক্যান্সার চিকিৎসার নতুন সম্ভাবনার দরজাও খুলে গেল।
এই প্রক্রিয়ায় পরিবারের বাইরের কোনো দাতার স্টেম সেল ব্যবহার করা হয়, যা এই অঞ্চলের চিকিৎসাক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। সম্প্রতি চিকিৎসকরা ১৯ বছর বয়সি এক রোগীর শরীরে এই ট্রান্সপ্লান্ট করেন। বর্তমানে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
রোগীর সাথে ড. আসিফ ইকবাল
স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট লিউকেমিয়াসহ বিভিন্ন হেমাটোলজিক্যাল রোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই চিকিৎসার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হল দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন (HLA) মিল নিশ্চিত করা। চিকিৎসক ও গবেষকদের মতে, সহোদরদের মধ্যেই হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন (HLA) ম্যাচ পাওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ২৫ শতাংশ, ফলে পরিবারের বাইরে উপযুক্ত দাতা খুঁজে পাওয়া আরও কঠিন হয়ে ওঠে। উত্তর-পূর্ব ভারতের নানা জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্য এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (BMT) ইউনিটের প্রধান চিকিৎসক ও অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর (অ্যাডাল্ট হেমাটোলজি) ড. আসিফ ইকবাল বলেন, “রোগীটি ছিল ১৯ বছর বয়সি এক যুবক, যার ক্যান্সার আবার ফিরে এসেছিল এবং প্রচলিত চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিল না। তার পরিবারের মধ্যে কোনো উপযুক্ত দাতা ছিল না। দীর্ঘমেয়াদে বেঁচে থাকার জন্য পরিবারের বাইরে থেকে দাতা পাওয়াই ছিল একমাত্র ভরসা।”
BBCI জুন মাস থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দাতা খোঁজার কাজ শুরু করে ড্যাট্রি ব্লাড স্টেম সেল ডোনার রেজিস্ট্রির মাধ্যমে, যা ভারতের অন্যতম বৃহৎ রেজিস্ট্রি। জুলাই মাসের মধ্যেই একজন সম্ভাব্য দাতাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
সম্পূর্ণ মাত্রায় রোগীর টোটাল বডি ইরেডিয়েশন গ্রহণ করার মুহূর্তে
দাতা চূড়ান্ত হওয়ার পর শুরু হয় এক জটিল প্রক্রিয়া, ভেরিফিকেশন টাইপিং, সংক্রামক রোগ পরীক্ষা, দাতার মেডিক্যাল অনুমোদন, ক্রায়োপ্রিজারভেশন অনুমোদন ইত্যাদি। দাতার অবস্থান ছিল পাঞ্জাবের লুধিয়ানায়, সেখান থেকে একাধিক রাজ্য পেরিয়ে স্টেম সেল পরিবহণ করতে হয়। সেই সময় রোগীর শরীরে কোনো মিনিমাল রেসিডুয়াল ডিজিজ (MRD) ছিল না, যা ট্রান্সপ্লান্টকে তুলনামূলকভাবে সহজ করে তোলে।
প্রায় ১৮.৫ লক্ষ টাকার এই ব্যয়বহুল প্রক্রিয়াটি সম্ভব হয়েছে দাতার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের আর্থিক সহায়তায়। দাতার কোষ একাধিক রাজ্য অতিক্রম করে আনতে হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আগেভাগেই সতর্কতা অবলম্বন করে। পাশাপাশি, জরুরি পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে রোগীর নিজের স্টেম সেলও সংগ্রহ করা হয়েছিল, যাতে প্রয়োজনে অটোট্রান্সফিউশন করা যায়।
ড. ইকবাল বলেন, “সচেতনতার অভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতে স্টেম সেল দাতার সংখ্যা খুবই কম। এই ছেলেটি ভাগ্যবান ছিল, কিন্তু এমন আরও অনেক রোগীর জন্য আমাদের আরও বেশি দাতার প্রয়োজন।”
স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টের মুহুর্তে
তিনি আরও জানান, “পাঞ্জাবের লুধিয়ানা থেকে জীবনদায়ী স্টেম সেল নিরাপদে একাধিক রাজ্য পেরিয়ে আনার জন্য দাতা সংস্থা, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, সরকারি বিভাগ, লুধিয়ানার অ্যাফেরেসিস সেন্টার এবং বিবিসিআই ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিটের মধ্যে নিখুঁত সমন্বয় প্রয়োজন ছিল।”
স্টেম সেল নিরাপদে পৌঁছানোর পর সঙ্গে সঙ্গে ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়, যদিও দাতা ও গ্রহীতার ABO রক্তের গ্রুপ এক ছিল না। রোগীর ক্ষেত্রে পূর্ণ মাত্রার টোটাল বডি ইরেডিয়েশন (TBI)-ভিত্তিক কন্ডিশনিং রেজিমেন প্রয়োগ করা হয়, যা বিবিসিআই-এর উন্নত সক্ষমতার পরিচয় দেয়। এই TBI প্রক্রিয়াটিও প্রতিষ্ঠানটির একটি বড় সাফল্য। রেডিয়েশন অনকোলজির সহকারী অধ্যাপক ড. কৌশিক কাটাকির তত্ত্বাবধানে এটি সম্পন্ন হয়। প্রয়োজনীয় লাং শিল্ড বিবিসিআই-তেই স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত করা হয়।
ড. আসিফ ইকবাল জানান, এই সাফল্যের পেছনে হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন, হেমাটোপ্যাথোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, রেডিয়েশন অনকোলজি এবং বিএমটি নার্সিং স্টাফদের নিখুঁত সমন্বয় ও নিষ্ঠা রয়েছে।
রোগী এবং অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে অধ্যাপক ড. আসিফ ইকবাল
স্টেম সেল দানকে জনপ্রিয় করতে ড. ইকবাল বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি জানান, আগামী জানুয়ারি মাসে রাজ্যে একটি সচেতনতা অভিযান শুরু করবেন। তিনি বলেন, “উত্তর-পূর্ব ভারতে ২০০-রও বেশি আদিবাসী সম্প্রদায় রয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে অনেক সময় তাদের বিখ্যাত সংস্থা বা সংগঠনের দ্বারস্থ হতে হয়, যাতে বাইরে থেকে স্টেম সেল দাতা খুঁজে পাওয়া যায়।”
ড. আসিফ ইকবাল জানান, উত্তর-পূর্ব ভারতে এখনও স্টেম সেল দান নিয়ে প্রায় কোনো সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। অথচ মানবদেহে প্রায় পাঁচ লিটার বোন ম্যারো থাকে, যার মধ্যে মাত্র ১৫০ মিলিলিটার দান করলেই ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত একজন মানুষ নতুন জীবন ফিরে পেতে পারেন। রক্তদানের মতোই এই প্রক্রিয়াটিও নিরাপদ ও সহজ। তিনি বলেন, সচেতনতা বাড়লে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণেই বহু রোগীর জীবনে আশার আলো ফেরানো সম্ভব, স্টেম সেল দানের মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিকই ক্যান্সারের বিরুদ্ধে এক নীরব যোদ্ধা হয়ে উঠতে পারেন।