মালগুড়ির ছায়ায় মধুপুর: যেখানে খেলার মাঠে গড়ে ওঠে সম্প্রীতির গল্প

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 12 h ago
মধুপুরের যুবকরা ক্রিকেট খেলছে (AI-জেনারেটেড)
মধুপুরের যুবকরা ক্রিকেট খেলছে (AI-জেনারেটেড)
 
মঞ্জিত ঠাকুর

ঝাড়খণ্ডের মধুপুর আমার শিকড়, একটি শান্ত, নিরিবিলি শহর, যার ছন্দে আছে স্নিগ্ধ অলসতা আর ভেতরে ভেতরে লুকোনো প্রাণচাঞ্চল্য। আর. কে. লক্ষ্মণের মালগুড়ি ডেজ-এর মতোই এই শহর চোখে পড়ে তার সরলতা ও মানবিক উষ্ণতায়। বাইরে থেকে শান্ত মনে হলেও, মধুপুরের প্রতিদিনে স্পন্দিত হয় সংস্কৃতি ও খেলাধুলার উল্লাস, যেন নীরবতার আড়ালে এক জীবন্ত হৃদস্পন্দন। 
 
এখানকার যুবসমাজের মধ্যে ক্রিকেট ও ফুটবল দু’টিই ভীষণ জনপ্রিয়। যদিও সারা ভারতেই ক্রিকেট একপ্রকার ধর্ম, তবুও বাংলার কাছাকাছি হওয়ার কারণে মধুপুরে ফুটবলের জনপ্রিয়তাও কম নয়। স্থানীয় ফুটবল ক্লাবগুলোর ম্যাচ দেখতে মানুষ টিকিট কেটে মাঠে যান।

Unforgettable Experiences

ভারতের অন্যান্য জায়গার মতো মধুপুরেও ক্রিকেট ছিল এক গভীর আবেগ। তবে আমার কাছে ক্রিকেট শুধু উপভোগের খেলা ছিল না; এটি আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, বিশ্বাস, জাত ও শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সৌহার্দ্যের সঙ্গে বাঁচতে হয়। ক্রিকেট আমাকে শিখিয়েছে, ধর্ম বা জাতের পার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে একজন মানুষের প্রতিভা ও গুণাবলিকে সম্মান করতে।
 
মধুপুরের তরুণ ক্রিকেটারদের সাথে কথা বলছেন লেখকের ভাই (AI-জেনারেটেড)
 
দ্বাদশ শ্রেণি শেষ করে বাড়ি ফেরার পর নিজের পরিবারেই ক্রিকেটের শক্ত শিকড় খুঁজে পাই। বড় ভাই মঙ্গল ঠাকুর আন্তঃজেলা স্তরের ক্রিকেটার ছিলেন; সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর মাঠ ছাড়েন। মেজো ভাই রতন ঠাকুর ক্লাব ক্রিকেট খেলে পরে বিশ্ববিদ্যালয় দলের সদস্য হন। তাঁদের দেখেই ক্রিকেট আমার জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে।
 
বোর্ডিং স্কুল থেকে ফেরার পর হাতে ছিল অফুরন্ত সময়। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা, সব সময় মাঠেই কাটত। সেই সময় মধুপুরে একটি নামকরা ক্রিকেট ক্লাব ছিল। (পাঠকেরা নিশ্চয়ই বুঝবেন, তাই এর নাম উল্লেখ করছি না।) শহরের প্রায় সব নামী ক্রিকেটারই সেই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
 
আমাদের বাড়ির আশপাশে ছিল তফসিলি জাতি ও দলিতদের বসতি। একটু দূরে ছিল একটি মুসলিম পাড়া, যেখানে মূলত পশমান্দা সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করতেন। তাঁদের বেশিরভাগই কাপড়ের ব্যবসায়ী বা তাঁতি ছিলেন। হস্তচালিত তাঁতশিল্পের পতনের পর তাঁরা কলকাতার ব্যবসায়ীদের জন্য বড় আকারে তৈরি পোশাক সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন।
 
আমাদের পাড়ার কয়েকজন উৎসাহী ক্রিকেটার, আমিসহ, সেই নামী ক্লাবের হয়ে খেলতে আগ্রহ প্রকাশ করি এবং মাঠেও যাই। আমার সতীর্থদের মধ্যে কয়েকজন দলিত ও চার-পাঁচজন মুসলিম বন্ধু ছিলেন। কিন্তু ক্লাবে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে মূলত বাংলাভাষী উচ্চবর্ণের হিন্দু ও আশরাফ মুসলিমরাই প্রভাবশালী। তারা আমাকে খেলতে দিতে রাজি হলেও আমার বন্ধুদের জন্য দরজা বন্ধ করে দিল। একটুও লজ্জা না করে তারা বলল, “এই নিচু শ্রেণির লোকদের আমরা খেলতে দেব না। ওরা আমাদের সঙ্গে কীভাবে খেলবে!”
 
তখন আমি বুঝতেই পারিনি, কেন আমি গ্রহণযোগ্য অথচ আমার বন্ধুরা নয়। আমরা তো একসঙ্গে হোলি ও ঈদ উদযাপন করতাম। যাই হোক, বন্ধুরা যখন খেলতে পারবে না, তখন সেখানে আমার একার খেলার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। বন্ধুদের ছেড়ে অপরিচিতদের সঙ্গে খেলার মানে হয় না। হতাশ হয়ে আমরা সবাই বাড়ি ফিরে এলাম।
 
সন্ধ্যা প্রায় পাঁচটার দিকে অফিস থেকে ভাই ফিরলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি কেন ক্লাবে খেলতে যাইনি। পুরো ঘটনাটা তাকে বললাম। ভাই খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। তিনি বললেন, “ওরা তোমাদের ‘চেথরি’ বলেছে?” মধুপুরে হরিজন, দলিত ও পশমান্দা মুসলিমদের স্থানীয়ভাবে “চেথরি” (অর্থাৎ ছেঁড়াখোঁড়া বা তুচ্ছ মানুষ) বলে ডাকা হতো।
 
সেদিনই সন্ধ্যায় আমার বড় ভাই উদ্যোগ নিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, আমাদের সব বন্ধুদের নিয়ে একটি নতুন ক্রিকেট দল গড়া হবে। আমরা ছিলাম কেবল ক্রিকেটপ্রেমী, কোনো রকম অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছাড়াই। আমাদের পাড়ার কাছেই অাঁচি দেবী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি বিশাল মাঠ ছিল, প্রায় সাত-আট হেক্টর জুড়ে।
 
মাঠের পেছনের দিকে আমরা একটি পিচ তৈরি করলাম। চারপাশে বেল, শিশম, সেগুন, আম, কাঁঠাল, চাঁপা ও কুল গাছের ছায়ায় মাঠটি যেন সবুজ ছাউনি হয়ে থাকত। ভাই পাড়ারই বাসিন্দা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হাশি রাশি বোসের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, এবং তিনি আমাদের খেলতে অনুমতি দেন।
 
মধুপুরের যুবকরা ক্রিকেট খেলছে (AI-জেনারেটেড)
 
ভাই দলের নাম রাখলেন চেথরি ক্রিকেট ক্লাব। পরে নাম বদলে ন্যাশনাল রাইজিং ক্লাব করা হয়, কিন্তু প্রথম নামটির সাহসী ও আলাদা পরিচয় মানুষের মনে থেকে যায়। ভাই আমাদের সবাইকে শপথ করালেন, মাঠে ও মাঠের বাইরে আমরা সবসময় ঐক্যবদ্ধ থাকব। আমাদের দলের এক শক্তিশালী ব্যাটসম্যানের ডাকনাম ছিল ‘জয়াসুরিয়া’, শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি ক্রিকেটারের নামে। উইকেটকিপারের নাম ছিল ‘মঈন’, পাকিস্তানের মঈন খানের নামে।
 
বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে বলা হতো ‘সৈয়দ আনোয়ার’। ফাস্ট বোলাররা ছিল ‘শ্রীনাথ’ ও ‘প্রসাদ’ (ভেঙ্কটেশ প্রসাদের নামে)। এক স্পিনারের নাম ছিল ‘রাজু’ (ভেঙ্কটপতি রাজুর নামে), কারণ প্র্যাকটিসে আমরা ওকে খুব মারতাম, আর ওর বল ছিল বেশ ধীরগতির।
 
এইভাবেই আমাদের দলে গাঙ্গুলি, টেন্ডুলকারসহ বহু ভারতীয় ও পাকিস্তানি ক্রিকেটারের নামে খেলোয়াড় ছিল। মজার বিষয়, মুসলিম খেলোয়াড়দের নাম দেওয়া হয়েছিল হিন্দু ক্রিকেটারদের নামে, আর হিন্দু খেলোয়াড়দের অনেকের নাম রাখা হয়েছিল মুসলিম ক্রিকেটারদের নামে। এই ক্লাব শুধু আমাদের বিনোদনের জন্য ক্রিকেটই দেয়নি, বরং আমাদের জীবনের এক অমূল্য শিক্ষা দিয়েছে, খেলা মানুষকে বিভক্ত করার জন্য নয়, মানুষকে এক করার জন্য।
 
আমাদের এক মুসলিম সতীর্থ ছিলেন দুর্দান্ত অলরাউন্ডার, দ্রুতগতির বোলার এবং ভালো ব্যাটসম্যানও। তিনি আমাদের দলের হয়ে বোলিং ও ব্যাটিং, দু’টাই শুরু করতেন। তাঁর নাম ছিল ‘ইমরান’। ঈদের সময় আমরা সবাই তাঁর বাড়িতে যেতাম এবং সেমাই খেতাম। ঈদ-উল-আজহায় তাঁর বাড়িতে বিরিয়ানি খাওয়া হতো। আসলে জীবনে প্রথমবার বিরিয়ানি খাওয়ার স্মৃতিটাও তাঁর বাড়ির সঙ্গেই জড়িত।
 
হোলির দিনে আমাদের বাড়িতেই দলের সবাই আসত। আমার মা কাঁঠালের তরকারির সঙ্গে মিষ্টি-টক তেঁতুলের চাটনি আর মালপোয়া পরিবেশন করতেন, সবাই খুব উপভোগ করত। আমি ছিলাম দলের একজন ফাস্ট বোলার এবং প্রায়ই ম্যাচের দ্বিতীয় ওভার করতাম। (প্রথম ওভারটি করত ইমরান খান।)
 
আমাকে কী নামে ডাকা হতো? সেটা থাক না হয় গোপনই!
 
(পাঠকেরা যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা আন্তধর্মীয় বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান, তবে প্রকাশের জন্য লিখতে পারেন: [email protected] - সম্পাদক)