হজ না প্রদর্শনী? ২০২৬ সালের হজে নিষিদ্ধ ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 8 h ago
রাখি সাওয়ান্ত উমরাহ পালনের একটি দৃশ্য।
রাখি সাওয়ান্ত উমরাহ পালনের একটি দৃশ্য।
 
গোলাম কাদির

বিশ্ব এখন এখন এমন এক যুগে পৌঁছেছে, যেখানে রিল ও সেলফির প্রতি প্রায় সব মানুষেরই প্রবল আকর্ষণ রয়েছে। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের সেলফি তুলতে দেখা যায়। মৃতদেহের সঙ্গে সেলফি তোলার এই ঘটনা প্রমাণ করে যে মানুষ পরিস্থিতি ও সংবেদনশীল পরিবেশের প্রতি কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না।
 
ধর্মীয় স্থানগুলোর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। যেখানে শান্তি, ধ্যান ও আধ্যাত্মিকতার পরিবেশ থাকার কথা, সেখানে মানুষ মোবাইল ক্যামেরা হাতে রিল ও ছবি তুলতেই ব্যস্ত। এই পরিবর্তিত আচরণ ও ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার দিকে নজর রেখে সৌদি আরব ২০২৬ সালের হজে মক্কার মসজিদ আল-হারাম ও মদিনার মসজিদ আন-নবাবীর ভেতরে যেকোনো ধরনের ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফির ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
 
এই নিষেধাজ্ঞা আগেও একাধিকবার কার্যকর করা হলেও এবার তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে। কারণ, গত কয়েক বছরে হজযাত্রীরা নিয়ম উপেক্ষা করে ধর্মীয় স্থানগুলোকে সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্ট তৈরির মাধ্যম বানিয়ে তুলেছিল। সৌদি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সিদ্ধান্তের পেছনে একাধিক গুরুতর কারণ রয়েছে।
 
বলিউড অভিনেত্রী সানা খান তার স্বামীর সাথে
 
প্রধান কারণ হলো, ছবি ও ভিডিও তোলার ধারাবাহিক চেষ্টায় মসজিদগুলোর পবিত্র পরিবেশ নষ্ট হচ্ছিল। কাবায় নামাজ আদায়ের পরিবর্তে অনেকেই পোজ দিচ্ছিলেন ও ভিডিও শুটিং করছিলেন। এতে শুধু পবিত্র স্থানগুলোর মর্যাদাই ক্ষুণ্ণ হয়নি, অন্যান্য ব্যক্তিদের মনোযোগ ও ইবাদতেও অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে।
 
দ্বিতীয় বড় কারণ হলো নিরাপত্তা। মসজিদ আল-হারাম ও মসজিদ আন-নবাবী বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ধর্মীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে প্রতি মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ মানুষ উপস্থিত থাকেন। এই জনসমুদ্রে কেউ হঠাৎ ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে গেলে অন্যদের চলাচলে অসুবিধা হয় এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। নিরাপত্তাকর্মীরা বারবার এ ধরনের আচরণকে গুরুতর বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিশেষ করে ব্ল্যাক স্টোন (জান্নাতের শীল), কাবা, রাওদা ও মসজিদের প্রবেশপথে এ সমস্যা আরও তীব্র হয়।
 
তৃতীয় বড় সমস্যা হলো গোপনীয়তার লঙ্ঘন। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ হজ ও উমরাহ পালনের জন্য আসেন। তাদের অনেকেই চান না, অচেনা কারও মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ছবি বা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ুক। কিন্তু ডিজিটাল যুগে অনুমতি ছাড়া রেকর্ডিং যেন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফলে এ নিয়ে অভিযোগও বেড়েছে।
 
চতুর্থ কারণ হলো ধর্মীয় মর্যাদা। সৌদি সরকারের মতে, মসজিদ আল-হারাম ও মসজিদ আন-নবাবী বিনোদন, শুটিং বা সামাজিক মাধ্যমে প্রদর্শনের জন্য নয়; বরং এগুলো একান্তই ইবাদতের স্থান। তাই এসব পবিত্র স্থানকে কনটেন্ট তৈরির মঞ্চে পরিণত করা তাদের পবিত্রতার পরিপন্থী। গত কয়েক বছরে সামাজিক মাধ্যমে প্রভাবশালী অনেকেই এখানে ভিডিও শুটিং করেছেন, যা অনেকের কাছে অস্বস্তিকর লেগেছে।
 
হজের সময় সহকর্মী বক্সারদের সাথে মাইক টাইসন
 
গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতাই এই নিষেধাজ্ঞাকে আরও জরুরি করে তুলেছে। ২০১৭ সালে প্রথমবার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ২০২৪ ও ২০২৫ সালে মন্ত্রণালয় হজযাত্রীদের সেলফি ও ভিডিও তোলা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেও অধিকাংশই তা গুরুত্ব দেয়নি। ২০২৫ সালে এই নিষেধাজ্ঞা মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফাতেও সম্প্রসারিত করা হয়। এরপর ২০২৬ সালের হজে এটি সম্পূর্ণ ও বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
 
তবে এই নিষেধাজ্ঞার যেমন সুফল আছে, তেমনি কিছু অসুবিধাও রয়েছে। ইতিবাচক দিক হলো, মসজিদগুলোতে আবার আধ্যাত্মিকতা ও শান্তির পরিবেশ ফিরে আসবে। মোবাইল ক্যামেরায় নয়, সবাই ইবাদতেই মনোযোগ দেবেন। জনসমাগমের বিশৃঙ্খলা কমবে, কারণ ছবি তুলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ার প্রবণতা থাকবে না। এতে চলাচল সহজ হবে এবং দুর্ঘটনার আশঙ্কাও কমবে।
 
গোপনীয়তা সুরক্ষা জোরদার হবে এবং কারও ছবি অনুমতি ছাড়া সামাজিক মাধ্যমে ছড়াবে না। ধর্মীয় স্থানগুলোর মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ থাকবে, কারণ এসব স্থান খ্যাতি অর্জন বা কনটেন্ট তৈরির জন্য নয়। পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহারও কমবে, কারণ অনেকেই জনপ্রিয়তা বাড়াতে মসজিদের ভেতরে ভিডিও বানাচ্ছিলেন।
 
অন্যদিকে, এই নিষেধাজ্ঞা কিছু চ্যালেঞ্জও তৈরি করবে। সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, অনেকে তাদের হজযাত্রার স্মৃতি ছবি হিসেবে সংরক্ষণ করতে পারবেন না। অনেকেই জীবনে প্রথমবার হজে যান এবং সেই মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করতে চান। আবার এমন অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন, যারা হয়তো দ্বিতীয়বার হজে যেতে পারবেন না, তাদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা কিছুটা বেদনাদায়ক হতে পারে।
 
হজ ও উমরাহ পালনকালে পরিবারের সাথে ক্রিকেটার ইরফান পাঠান
 
এছাড়া, এত বড় পরিসরে এই নিয়ম কার্যকর করাও সহজ নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে কে মোবাইল বের করছে, তা নজরদারি করা নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। কেউ কেউ এটিকে ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলেও মনে করতে পারেন, যদিও বাস্তবে এই নির্দেশনা এসেছে নিরাপত্তা ও পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থেই। তদুপরি, হজযাত্রীদের এখন ব্যক্তিগত ছবির বদলে সরকারি রেকর্ডিংয়ের ওপর নির্ভর করতে হবে, যা সবার চাহিদা পূরণ নাও করতে পারে।
 
তবুও বলা যায়, হজযাত্রার মূল উদ্দেশ্য প্রদর্শন বা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া নয়। হজের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত, তওবা, ধৈর্য ও আত্মিক সংশোধন। ক্যামেরা থেকে দূরে থাকলে এই অভিজ্ঞতা আরও গভীর হতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে স্মৃতি সংরক্ষণ ভুল, তবে ইবাদতের স্থানে তার সময় ও পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে যদি সৌদি সরকার নিয়ন্ত্রিত বা নির্ধারিত ফটো-জোন চালু করে, তাহলে তা উভয় পক্ষের জন্যই একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান হতে পারে।
 
কিন্তু কাবা, রাওদা ও মসজিদের ভেতরে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা যথার্থ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। শেষ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের নিরাপত্তা, পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা রক্ষার স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই নিয়মকে সম্মানের সঙ্গে মেনে চলা এবং হজকে তার প্রকৃত আধ্যাত্মিক অর্থে পালন করাই হজযাত্রীদের দায়িত্ব।