দীঘার জগন্নাথ মন্দিরে সম্প্রীতির সুর: ধর্ম ছাপিয়ে ভক্তি, পর্যটন ও মানবতার মেলবন্ধন

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 26 d ago
দীঘার জগন্নাথ মন্দির
দীঘার জগন্নাথ মন্দির
 
শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ, দীঘা

পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় সমুদ্রতীরবর্তী শহর দীঘা আজ শুধু সৈকতের ঢেউ বা সোনালি বালুকাবেলার আনন্দে নয়, বরং এক অনন্য বার্তায় সারা দেশ জুড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, সেই বার্তা ধর্মীয় সম্প্রীতির। এই বার্তার প্রতীক হয়ে উঠেছে দীঘার নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দির, যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি ও মানবতা মিশে গেছে এক সুরে।
 
পুরীর ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ মন্দিরে যেমন অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, দীঘার এই মন্দিরে তার একেবারে বিপরীত ছবি। এখানে দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত, হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, এমনকি বিদেশি পর্যটকরাও অবাধে প্রবেশ করেন মন্দির প্রাঙ্গণে। উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার থেকে ঘুরতে আসা নাজিমা সুলতানা বলেন,“সত্যিই মনে শান্তি পেলাম। এখানে কেউ কাউকে আলাদা চোখে দেখে না। সবাই একসঙ্গে ঘুরছে, ছবি তুলছে, মনে হয়, আমরা সবাই একই পরিবারের।”
 
দীঘার নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরে উপস্থিত কিছু মুসলিম নারীদের ছবি
 
একই অনুভূতির কথা জানালেন কলকাতার পর্যটক অর্ণব সেনগুপ্ত। তাঁর কথায়, “পুরীর মন্দিরে যাওয়া যায় না বলে খারাপ লাগত। এখানে এসে মনে হচ্ছে, জগন্নাথ সত্যিই ‘সর্বজনের প্রভু’। এই মন্দির এক নতুন ভাবনার দিক খুলে দিয়েছে।”
 
মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পণ্ডিত অনিল মিশ্র বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, ঈশ্বর কারও একার নয়। তাই আমাদের মন্দিরে কোনো ধর্মের মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। সবাই যদি একই ছাদের নিচে প্রার্থনা করে, সেটাই তো প্রকৃত ভক্তি।”
 
মন্দিরের স্থাপত্যও দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্র। বিশাল গম্বুজ, সূক্ষ্ম ভাস্কর্য ও অলঙ্কৃত খোদাই, সব মিলিয়ে এই মন্দির একদিকে শিল্পের নিদর্শন, অন্যদিকে ধর্মীয় সহাবস্থানের প্রতীক। ভোরের আলো পড়তেই গম্বুজে ঝলমল করে ওঠে সোনালি আভা, আর সেই দৃশ্য দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করেন শত শত পর্যটক।
 
দীঘার নবনির্মিত মন্দির ও হিন্দু- মুসলিম সকলের জনসমাগম
 
স্থানীয় বাসিন্দা সুব্রত দে জানান,“মন্দির তৈরি হওয়ার পর থেকে দীঘায় পর্যটক বেড়েছে। হিন্দু-মুসলিম সবাই একসঙ্গে দোকান চালাই, ব্যবসা করি। এখানে কারও ধর্ম নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই, সবাই মানুষ হিসেবেই কাজ করে।” মন্দিরের চারপাশে এখন হস্তশিল্পের দোকান, খাবারের স্টল ও স্থানীয় বাজার জমে উঠেছে। এতে কর্মসংস্থান বেড়েছে, উপকৃত হচ্ছেন বহু পরিবার। পর্যটন বিভাগও এলাকাটিকে “সম্প্রীতির পর্যটন কেন্দ্র” হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছে।
 
রাজ্যের পর্যটন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান,“দীঘার জগন্নাথ মন্দির এখন শুধুমাত্র ধর্মীয় স্থান নয়, এটি সামাজিক সম্প্রীতির এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। আমরা চাই এই ভাবনাই এখানকার মূল আকর্ষণ হয়ে উঠুক।” প্রশাসনের তরফে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও মন্দিরে প্রবেশে কোনো কঠোর বিধিনিষেধ নেই। দর্শনার্থীদের কেবল অনুরোধ করা হয় সম্মান ও সৌজন্য বজায় রাখতে।
 
ভোরবেলায় সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন গম্বুজে পড়ে, তখন মন্দিরচত্বর ভরে ওঠে অপার্থিব সৌন্দর্যে। কেউ প্রার্থনা করেন, কেউ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন, কেউবা ক্যামেরায় বন্দি করেন সেই মুহূর্ত। ধর্ম ভিন্ন হলেও আবেগের সুর এক, মানবতার সুর। আজ যখন দেশ-বিদেশে ধর্মীয় বিভাজন ও সংঘাতের খবর ঘন ঘন শোনা যায়, তখন দীঘার এই জগন্নাথ মন্দির এক ভিন্ন বার্তা দেয়, “ধর্ম ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মানুষ এক।”
 
দীঘার নবনির্মিত মন্দির
 
দীঘার নবনির্মিত এই মন্দির তাই কেবল ভক্তির স্থান নয়, এটি এক মানবতার মন্দির, ভারতের সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
 
তথ্যসংক্ষেপ
 
* অবস্থান: নিউ দীঘা, পূর্ব মেদিনীপুর
 
* প্রবেশ সময়: সকাল ৬টা–রাত ৮টা
 
* প্রবেশ ফি: নেই
 
* ফটোগ্রাফি: প্রতিবেদক 
 
* নিকটবর্তী আকর্ষণ: নিউ দীঘা সৈকত, মারিন অ্যাকোয়ারিয়াম, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক